মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড গড়েছে। এক যুগের মধ্যে এ হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দুই অঙ্কের একেবারেই কাছাকাছি অর্থাৎ ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে টানা তিন মাস মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার বেশি মাত্রায় বাড়লেও মজুরির হার বেড়েছে তুলনামূলকভাবে কম। মে মাসে মজুরির হার বেড়েছে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বেড়েছে ২ দশমিক ৬২ শতাংশ কম। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। ওই মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি কম বেড়েছিল ২ দশমিক ০১ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষের আয় বাড়ছে কম, খরচ বাড়ছে বেশি। ফলে বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্য-আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। তারা জীবিকানির্বাহ করতে খরচের খাতা ছোট করছেন। অনেকে ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কনজুমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই) প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার সংস্থাটি এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ আমার জানা নেই। কেননা বোরো ধান ভালো হয়েছে। বাজারেও চালের দাম স্থিতিশীল। তারপরও কেন মূল্যস্ফীতির হার এত বেড়ে গেল, বুঝতে পারছি না। তবে এর একটা বড় কারণ হতে পারে ভোজ্যতেলসহ যেসব নিত্যপণ্য আমদানি করে আনতে হয়, সেগুলোর কারণে দাম বাড়তে পারে। কেননা ডলারের দাম বেড়ে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ডলারে পণ্য কিনতে গেলে আমাদের দেশে দাম বেশি পড়ে যায়। সেই সঙ্গে আমদানি পণ্যের দাম বেশি হলে দেশীয় পণ্যের দামে এর প্রভাব পড়ে। এসব মিলেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে। এটা আমার বিশ্বাস। ভবিষ্যৎই বলে দেবে কী হবে? প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে হয়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আগে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়লেও এখন কমতে শুরু করেছে। আগে শহরে কম বেড়েছে, এখন শহরে বেশি বাড়ছে। গ্রামে এখন মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং শহরে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গ্রামের চেয়ে শহরে এ হার এখন বেশি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গ্রামের চেয়ে শহরে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আগে মূল্যস্ফীতি ছিল উলটোমুখী যাত্রায়। অর্থাৎ শহরে কম বেড়েছে, গ্রামে বেশি বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সর্বত্রই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য, গ্রাম ও শহর সব জায়গায় মূল্যস্ফীতির ছাপ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি গেড়ে বসেছে। এক্ষেত্রে ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমানোর খেসারত দিতে হচ্ছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে শুধু যে ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে তা নয়, এর সঙ্গে শিল্পের কাঁচামাল এবং প্রক্রিয়াগত পণ্যও (যেমন: স্পেয়ার্স পার্টস) আমদানি কমেছে। ফলে উৎপাদন কমে গিয়ে সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি সংকট বেশি জ্বালাচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ-এসব না থাকলে তো উৎপাদন হবে না।
তিনি আরও বলেন, আগের মাসগুলোর মূল্যস্ফীতির একটা প্রভাব তো আছেই। পাশাপাশি চাহিদার দিক থেকে উলটো পথে হেঁটেছে সরকার। চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো যেত। সেটি হয়নি। বরং বেড়েছে। সরকারি ঋণের যে অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে, এতে চাহিদা বেড়েছে। ফলে এতেও মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।
সূত্র জানায়, ঈদের পর গত মে মাসে হঠাৎ সব ধরনের পণ্যমূল্য লাগামহীনভাবে বাড়ায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ওই মাসে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে। এর বিপরীতে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতেও মন্দা বিরাজ করছে। এ কারণে মানুষের আয় বেড়েছে কম। ডলার সংকট দীর্ঘ সময় ধরে থাকায় আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে এখন পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এখন মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসাবে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রভাব এখনো মূল্যস্ফীতিতে রয়েছে। আগামী দিনে এগুলোর দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে।
বৈশ্বিক মন্দা শুরুর পর গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে এই হার কমতে ছিল। গত জানুয়ারিতে তা কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নামে। এর পর থেকে আবার বাড়তে থাকে। গত মার্চে এ হার বেড়ে ৯ শতাংশ অতিক্রম করে, যা টানা তিন মাস অব্যাহত রয়েছে। এবার ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ২০ শতাংশে উঠেছিল। সেটাই ছিল বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। এরপর আর মূল্যস্ফীতির হার এত বাড়েনি।
এদিকে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই সীমার মধ্যে রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিবিএস সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৮ ও ৯ শতাংশের ঘরেই ওঠানামা করছে। এর নিচে নামছে না। জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ১৯, আগস্টে ৯ দশমিক ৫২, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ১০, অক্টোবরে ৮ দশমিক ৯১, নভেম্বরে ৮ দশমিক ৮৫ এবং ডিসেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। এছাড়া জানুয়ারিতে ৮ দশমিক ৫৭, ফেব্রুয়ারিতে ৮ দশমিক ৭২, মার্চে ৯ দশমিক ৩৩ এবং এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে বাড়লেও মজুরি হার বাড়ছে ধীরগতিতে। ফলে মানুষের খরচের চেয়ে আয় বাড়ছে কম। মে মাসে মজুরি হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৩২, এপ্রিলে ছিল ৭ দশমিক ২৩, মার্চে ৭ দশমিক ১৮, ফেব্রুয়ারিতে ৭ দশমিক ১১, জানুয়ারিতে ৭ দশমিক ০৬ এবং ডিসেম্বরে ৭ দশমিক ০৩ শতাংশ বেড়েছিল।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বৈশ্বিক মন্দা শুরুর পর থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে, মানুষের আয় বাড়ছে কম। উলটো অনেক ক্ষেত্রে আয় কমে যাচ্ছে। আগে মূল্যস্ফীতির চেয়ে আয় বেড়েছে বেশি। এখন মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে আয় বাড়ছে কম। মন্দার শুরুতে মূল্যস্ফীতির তুলনায় আয় কম বাড়ার হার ১ শতাংশের মধ্যে ছিল। এখন তা বেড়ে আড়াই শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
News Link