সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সংকরহাটি গ্রাম। এ গ্রামের শিক্ষক বাঞ্ছারাম সরকার জানান, গত শুক্রবার রাত ১০টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত তাঁদের এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। এরপর বিদ্যুৎ এসেছিল, তবে মাত্র ২০ মিনিটের জন্য। তারপর সেই যে গেল, সকাল ৯টার আগ পর্যন্ত আর আসেনি। চরম গরমে এভাবে বারবার বিদ্যুৎ যাওয়ায় রাতে ঘুম হচ্ছে না। ফলে দিনের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, একই অবস্থা দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও। তীব্র তাপপ্রবাহে নাকাল জনজীবনে বিদ্যুতের এই আসা-যাওয়া যন্ত্রণার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিদ্যুতের জন্য ভুগছে শিল্পকারখানাও। মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে উৎপাদন। গাজীপুরের একটি শিল্পকারখানার ব্যবস্থাপক সিরাজুল হক জানান, গতকাল রোববার সারাদিনে এক-দেড় ঘণ্টা করে অন্তত পাঁচবার বিদ্যুৎ গেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে দিনে আমাদের প্রায় ১ লাখ টাকার ডিজেল খরচ যাচ্ছে। যখন তখন বিদ্যুৎ যাওয়ায় কারখানা চালু করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লোডশেডিং পরিস্থিতি যে অসহনীয় হয়ে উঠেছে, তা স্বীকার করে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে সূচি ধরে লোডশেডিংয়ের পরিকল্পনা আপাতত নেই।
সরকার বলছে, ডলার সংকটে তেল ও গ্যাস আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। তাই চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা দৈনিক সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। তবে খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। গত শুক্রবার রাত ১২টায় ৩ হাজার ৮১ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের তথ্য দিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, যা এ পর্যন্ত রেকর্ড। এর আগে গত ১৩ মে সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল ২ হাজার ৯৫ মেগাওয়াট।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুতে বর্তমানে ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, যা নিকট অতীতের মধ্যে সর্বোচ্চ। তারপরও পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না সরকার। কারণ কয়লাভিত্তিক রামপাল, পায়রা ও বরিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি সংকটে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। গত শনিবার প্রায় ৪ হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হয়েছে। আর কেন্দ্র মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য ৩ হাজার ২৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়নি। দেশের সবচেয়ে বেশি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড চাহিদার ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। খোদ ঢাকাতে দিন-রাত লোডশেডিং হচ্ছে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানা চালানোই মুশকিল হয়ে গেছে। ডিজেল খরচ বেড়ে গেছে। এরপরও যদি আমাদের জানা থাকত, কখন বিদ্যুৎ যাবে, কখন আসবে, তাহলে সে অনুসারে শ্রমিকদের কাজে লাগানো যেত। এখন তো লোডশেডিংয়ের কোনো শিডিউল নেই।
দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। দুই সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘হিটওয়েভ হচ্ছে। ফলে চাহিদা বেড়ে গেছে। জ্বালানি জোগান দিতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক কেন্দ্র অর্ধেক উৎপাদন করছে। ফলে কিছুদিন ধরে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। এখন ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। পরিস্থিতি যে অসহনীয়, তা জানি। দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কত তাড়াতাড়ি আনা যায়, সে চেষ্টা চলছে। আশা করি, ১০-১৫ দিনের মধ্যে এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। শিডিউল লোডশেডিংয়ে যাওয়ার চিন্তা আপাতত নেই। দুই সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।’
জ্বালানি সংকটের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘দুই মাস আগে থেকেই চেষ্টা করছিলাম। অর্থনৈতিক বিষয় থাকে, এলসি খোলার বিষয় থাকে– সব সমন্বয় করতে হয়। আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত করে বসে আছি। জ্বালানি আসার পেছনের বিষয় সব সময় আমাদের হাতে থাকে না। সমন্বয় কোথাও বাধাগ্রস্ত হলেই সমস্যা হয়। এবারও তাই হয়েছে। সমন্বয় হলে জ্বালানি সংকট হতো না।’