বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয় এমন ব্যক্তিদের করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২০০০ টাকা কর দিতে হবে, যা নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই নিয়ম কার্যকর করা হবে। যা নিয়ে জনমনে বেশ ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। অসচ্ছল ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে অস্বস্তি। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমেও ট্রোলসহ সমালোচনার ঝড় বইছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে সাধারণ মানুষ শঙ্কায় আছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ন্যূনতম করের বোঝা এমন সময় চাপতে যাচ্ছে, যারা এই মুহূর্তে বেশ খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক ক্ষেত্রে লাগামছাড়া; বাড়িভাড়া, যানবাহনের খরচ, নানা পরিষেবার বিল, সন্তানের পড়াশোনার খরচ-সব মিলিয়ে কষ্টে আছেন। ফলে চাপে থাকা মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
এদিকে আয় করমুক্ত সীমার নিচে হলেও সরকারি ৩৮টি সেবা নিতে টিআইএনের বিপরীতে ২ হাজার টাকা কর নেয়ার বিধানকে বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ৪৪ ধরনের সেবা নিতে গেলে একজন টিআইএনধারীকে দুই হাজার টাকা ন্যূনতম আয়কর দিয়ে রিটার্ন দাখিল করে তার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার যদি আয়কর দেয়ার মতো আয় নাও থাকে, তারপরও তাকে ২ হাজার টাকা আয়কর পরিশোধ করতে হবে।
যদিও করমুক্ত আয়ের সীমা বলে একটি বিধান রয়েছে এবং আগামী অর্থবছরের জন্য ওই সীমার ক্ষেত্রে আরও ছাড় দেয়া হয়েছে। এখন একজন ব্যক্তির ৩ লাখ টাকা আয়ের ওপর তাকে কোনো কর দিতে হয় না। নতুন অর্থবছরে এটা বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে।
দেশের প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ আছেন, যাদের একটি কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন রয়েছে। নানা কারণে তারা এটি নিয়েছেন। এদের মধ্যে ৩০ লাখেরও কিছু বেশি মানুষ তাদের রিটার্ন জমা দেন। তাদের অনেকেই শূন্য কর দেখিয়ে রিটার্ন জমা দেন, অর্থাৎ আয়কর দেয়ার মতো আয় তাদের নেই। নতুন বাজেট কার্যকর হলে বিপদে পড়বেন তারা। এরপর ঝামেলায় পড়বেন, যাদের ৪৪টি সেবার কোনো একটি নেয়ার প্রয়োজন হবে। ফলে অসচ্ছল ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষও সরাসরি করের আওতায় আসছে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন গৃহিণীর ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। কিন্তু তার করযোগ্য আয় নেই। দুই বছর আগে ব্যাংকে শুধু টিআইএন জমা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন। চলতি অর্থবছরে টিআইএনের পরিবর্তে ব্যাংকে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হয়। স্লিপ না দিলে সঞ্চয়পত্রের সুদ আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটার বিধান রয়েছে। আর স্লিপ জমা দিলে ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়। বাড়তি উৎসে কর কাটার হাত থেকে বাঁচতে চলতি অর্থবছরে ওই গৃহিণী শূন্য রিটার্ন জমা দিয়ে স্লিপ নিয়েছেন। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে শূন্য রিটার্ন জমা দিলেও স্লিপ পেতে তাকে দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।
সূত্র জানায়, গত বছরে বাজেট পেশ করার সময় বলা হয়েছিল, ৩৮টি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। ন্যূনতম করের বিষয়টি তখন ছিল না। এবারের বাজেটে এই সংখ্যা আরও ৬টি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। টিনধারীদের ন্যূনতম করের কোনো যৌক্তিকতা নেই উল্লেখ করে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের ৩৮টি সেবা নিতে হলে টিন লাগবে। টিনধারীর করযোগ্য আয় না থাকলেও এই ৩৮ সেবা নিতে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। যদি কারও আয় সাড়ে ৩ লাখের নিচেও হয়। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলো মানুষকে স্বস্তি দেয়ার জন্য, আবার যার করযোগ্য আয় নেই তাকে কর দিতে হবে, এটা সাংঘর্ষিক। এটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, মানুষকে স্বস্তি দিতে এখানে করমুক্ত আয় বাড়িয়ে আবার যার করযোগ্য আয় নেই তার উপর ২ হাজার টাকার কর আরোপ করা এটা কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয় তা আমরা খুঁজে পাই না। এ নিয়ম তুলে দেয়া হোক। তিনি বলেন, যে কর দেয়ার যোগ্য, ক্ষমতা-আয় আছে সেই তো কর দেবে, কিন্তু যার নাই তার ওপর আবার বসিয়ে দিলাম। এটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। নৈতিকভাবেও এটা ঠিক না। এটা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে। ফলে মূল যে উদ্দেশ্য ছিল সেটিও নষ্ট হয়ে গেল।
যেসব সেবা পেতে রিটার্ন স্লিপ বাধ্যতামূলক: ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিলে, কোম্পানি পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হলে, আমদানি-রপ্তানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি-ইআরসি) নিতে, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে, সমবায় সমিতি নিবন্ধন নিতে, বীমা কোম্পানির সার্ভেয়ার হতে, ১০ লাখ টাকার বেশি ক্রেডিটসম্পন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে ও সচল রাখতে, ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি-ফ্ল্যাটের দলিল করতে, ক্রেডিট কার্ড নিতে, পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ নিতে, ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স ও ছাড়পত্র পেতে, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সন্তান ভর্তি করতে, কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিতে, অস্ত্রের লাইসেন্স নিতে, ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে, ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে, নির্বাচনে অংশ নিতে, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১৬ হাজার টাকা হলে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ করলে, পণ্য আমদানি-রপ্তানির বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক।
আগামী অর্থবছরে এর সঙ্গে আরও ৬টি সেবা যুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন পেতে; জমি, ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট লিজ রেজিস্ট্রেশনকালে, দেশের সব এলাকায় ১০ লাখ টাকা মূল্যের দলিল রেজিস্ট্রিকালে, ট্রাস্ট, ফান্ড, এনজিও, ফাউন্ডেশন, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা, সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খুলতে ও সচল রাখতে, বাড়ি ভাড়া নেয়ার সময় বাড়ির মালিকের এবং পণ্য ও সেবা গ্রহণের সময় সরবরাহকারীর রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
News Link