বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য শুধু মানুষের আয়ে ঝুঁকি তৈরি করেনি। জাতীয় অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করেছে। কারণ পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। তা মোকাবিলায় গরিব মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গতিশীল করতে সরকারের দায় বাড়ছে।
নিত্যপণ্য মূল্য ছাড়া অর্থনীতির জন্য আরও সাত ধরনের ঝুঁকি শনাক্ত করেছে অর্থ বিভাগ। অন্য ঝুঁকিগুলো হচ্ছে-অস্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হার, ঋণের সুদ ও ভর্তুকি ব্যয়, রাজস্ব কমে যাওয়া, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাত।
এসব ঝুঁকি শেষ পর্যন্ত আর্থিক ব্যবস্থাকে খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবল (আইএমএফ)-এর শর্ত হিসাবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনীতি কাঠামোতে।
পাশাপাশি এসব ঝুঁকি কমিয়ে আনতে আগামী দিনগুলোতে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে সূত্রভিত্তিক ফর্মুলা প্রণয়ন ও মূল্য সমন্বয়, ভর্তুকি কমিয়ে আনা, থোক বরাদ্দ বাড়ানো ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের কৌশলের কথাও বলা হয়েছে।
অর্থনীতিতে এ ধরনের ঝুঁকি নির্ধারণ এবং নিরসনে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে আগাম প্রস্তুতি এবারই প্রথম। বিগত সময়ে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে বিআইডিএস’র সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি শনিবার যুগান্তরকে বলেন, অর্থনীতিতে ঝুঁকি শনাক্ত ও নিরসনের কৌশল আগাম প্রকাশ ভালো উদ্যোগ। তবে এসব ঝুঁকি আসছে কিনা সেগুলোর পূর্ভাবাস দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে বোঝা যায় যে ঝুঁকি আসছে, কিংবা ঝুঁকির গভীরতা বোঝা যায়। শুধু শনাক্ত করলে হবে না, পরিমাপ করার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এছাড়া এ কাজ পরিসংখ্যান ব্যুরো করবে না মন্ত্রণালয় করবে সেটিও নির্ধারণ করে দিতে হবে।
সূত্র মতে, অর্থনীতিতে আগাম ঝুঁকি প্রসঙ্গে বলা হয়, জ্বালানি তেল, সারের মূল্য ও ভর্তুকির বিল সরকারের ব্যয়কে প্রভাবিত করে। এসব ব্যয় জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে আঘাত আনতে পারে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার, মুদ্রা বিনিময় হার ও পণ্যের মূল্যকেও প্রভাবিত করছে।
পাশাপাশি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে রাজস্ব এবং সরকারি ঋণের স্থিতি ও গতি প্রকৃতিতে। সেখানে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাত, জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত ঘটনাবলি, অস্থিতিশীল বিনিয়ম হার ও সরকারের বড় দায় আগামীতে অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
আগাম ঝুঁকির পূর্বাভাসে আরও বলা হয়, কমপ্লায়েন্স এবং রেগুলেটরি এই দুই ঝুঁকি রাজস্বের ক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনী পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও সুদ পরিশোধ ব্যয়ের মতো চ্যালেঞ্জগুলো আর্থিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
বর্তমান নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অধিক মূল্যের কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আকার আরও গতিশীল করতে গিয়ে সরকারের আর্থিক দায় বাড়বে। অপর দিকে সুদ পরিশোধ ব্যয় দেশের মোট আর্থিক ব্যয়ের বড় একটি অংশ।
চলতি অর্থবছরে সুদ পরিশোধ খাতে সরকারকে ৯০ হাজার ১৩ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এটি মোট ব্যয়ের ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ফলে সুদ পরিশোধ ব্যয়ের অভিঘাত আর্থিক ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পুনঃমূলধনীকরণ এবং তাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আর্থিক খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিক আর্থিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমকে সংকুচিত করতে পারে।
অস্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হার প্রসঙ্গে বলা হয়, বিনিময় হারে হঠাৎ করে অবচিতি ঘটলে সরকারের ঋণ বাড়তে পারে। সাম্প্রতিক অবচিতি বিভিন্নভাবে আর্থিক ভারসাম্য এবং ঋণের সামগ্রিক পরিমাণকে প্রভাবিত করেছে। এটি সরকারের রাজস্ব ও ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স হ্রাস এবং টাকা অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে।
সেখানে আরও বলা হয়, মুদ্রা বিনিময় হারের ঊর্ধ্বগতি ভর্তুকি ব্যয়কে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে ৬৬ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়।
আর মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান এক টাকা কমলে আগামী অর্থবছরে শুধু বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বেড়ে যাবে ৪৭৩ কোটি টাকা। এছাড়া বাড়বে প্রকল্পের ব্যয়ও।
এছাড়া মুদ্রা বিনিময় হার সরকারের ঋণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাত প্রসঙ্গে বলা হয়, এই অতিমারি জনগণের জীবন জীবিকাকে বিপন্ন করেছে এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করেছে। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে দুই লাখ ৩৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিতে হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি প্রসঙ্গে বলা হয়, এর মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বাজেটে ৩৭ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারের ২৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ অর্থ ব্যয় করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কৌশলপত্রে বলা হয়, ‘আপাত দৃষ্টিতে প্রণীত বাজেট ও সরকারের ঋণ পরিস্থিতি ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু অফ ব্যালেন্সশিট ও অন্তর্নিহিত দায়ের কারণে বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে।’ বাজেট ঘাটতি ও ঋণ কমানোর চাপ কিছু ক্ষেত্রে বাজেটের বাইরে সরকারি কার্যক্রম এমনভাবে স্থানান্তর হয়, এতে খরচ ও ঝুঁকি বাড়ায়।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এপ্রিল মাসে ঢাকা সফরকালে আইএমএফ প্রতিনিধি দল অর্থ বিভাগের সঙ্গে সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠককালে এ প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে অর্থনীতিতে আগাম ঝুঁকি প্রকাশ করা হয়। আইএমএফ সে কৌশল নিতে অর্থ বিভাগকে পরামর্শ দিয়েছে।
সংস্থাটির পরামর্শে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা ঝুঁকির কথা প্রকাশ করলেও এসব ঝুঁকি আসবে এমনটি নয়। যদি এসেই পড়ে তাহলে সে ক্ষেত্রে কী উদ্যোগ নেওয়া হবে তা সেখানে প্রস্তুতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থ বিভাগ অর্থনীতিতে যেসব ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে সেগুলো নিরসনে বেশ কিছু কৌশল তুলে ধরেছে। এসব কৌশলে বলা হয়, সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে ঝুঁকি কিছুটা লাঘব হয়েছে। সরকার আগামীতে একটি সূত্রনির্ভর মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া চালু করবে। ফলে পেট্রোলিয়াম পণ্যগুলোর জন্য কোনো কাঠামোগত ভর্তুকির প্রয়োজন হবে না। তবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের জন্য ভর্তুকির ক্ষেত্রে কোনো নীতি গ্রহণ করেনি।
সেখানে আরও বলা হয়, একদিকে ভর্তুকি কমাতে হবে অন্যদিকে রাজস্ব বাড়াতে হবে। তাহলে আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি কমবে। পাশাপাশি যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বাজেটে থোক বরাদ্দ বেশি অঙ্কের রাখতে হবে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতির মাধ্যমেও ঝুঁকি কমানোর কথা বলা হয়েছে।
আইএমএফ’র সংজ্ঞায় সরকারি বাজেট বা অন্যান্য আর্থিক পূর্বাভাসে যা প্রত্যাশা ছিল তার তুলনায় স্বল্পমেয়াদে বিচ্যুতির সম্ভাবনাকে আর্থিক ঝুঁকি হিসাবে দেখা হয়।