রাজশাহী ব্যুরো ও রাবি রিপোর্টার: এক অনির্দিষ্টকালীন অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। শিক্ষক-কর্মচারিদের দলাদলিতে একরকম বিপন্ন দশা চলছে শিক্ষা কার্যক্রমে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে হতাশা। শিক্ষকদের চাপের মুখে ভিসি’র পদত্যাগের পর এখন কান্ডরীবিহীন অবস্থায় পড়েছে রুয়েট।
রুয়েট-এর ৫ জন শিক্ষক ও ৪ জন কর্মকর্তাকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ‘মৃত্যুর প্রতীক’ হিসেবে দুই টুকরো সাদা কাপড় পাঠানো নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা আজো কাটেনি। এর মধ্যে পর পর দু’জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার প্রকাশ ঘটায়। বাইরের রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে ক্যাম্পাসে সরকারপন্থী শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলনের মহড়াও ক্যাম্পাসে অহেতুক উত্তেজনা ছড়ায়। আবার শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে দিনভর অবরুদ্ধ থাকার পর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ভিসি পদত্যাগ করেন। এরপর থেকেই ভিসিশূন্য রয়েছে রুয়েট।
ভিসি’র পদত্যাগ: গত রোববার সকাল থেকে রুয়েটের অর্ধশতাধিক শিক্ষক তাদের পদোন্নতির দাবিতে রুটিন দায়িত্বের ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেনকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। শেষে চাপের মুখে রাত সোয়া ৯টার দিকে তিনি পদত্যাগ করেন। এর আগে গত বছরের ৩০ জুলাই রুয়েট ভিসির পদ শূন্য হয়ে যায়। এরপর ১০ মাস থেকে রুটিন দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে ভিসি’র দায়িত্ব পালন করছিলেন অ্যাপ্লাইড সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন। ভিসি’র পদত্যাগের পর গত সোমবার ক্লাস-পরীক্ষা রুটিন অনুযায়ী হলেও শিক্ষক কর্মকর্তারা পড়েছেন হতাশায়। তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এ অবস্থায় রুয়েটের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। তারা এখন ‘উপরে’র (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন। আন্দোলনরত শিক্ষকদের অভিযোগ, ১১ মাস ধরে ক্যাম্পাসে নিয়মিত ভিসি নেই। অভিভাবক না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে চরম স্থবিরতা নেমে এসেছে। এছাড়া সব শর্ত পূরণ করেও গত ১৫ মাসে অন্তত ৮০ জন শিক্ষক তাদের ন্যায্য পদোন্নতি ও আপগ্রেডেশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
‘সাদা কাপড়’ রহস্য: গত বছর ২২ ডিসেম্বর রুয়েট-এর ৫ জন শিক্ষক ও ৪ জন কর্মকর্তাকে দুই টুকরো সাদা কাপড় পাঠানো হয়। সাদা কাপড়ের ওই দুই টুকরা ‘লাশ দাফনের জন্য’ ব্যবহৃত কাফনের কাপড় বলে নিরাপত্তার আশঙ্কা করেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীরা। ‘সচেতন নাগরিক সমাজ’-এর ব্যানারে সরকারি ডাকে চিঠিগুলো তাদের অফিসে পাঠানো হয়। সেই ঘটনায় মতিহার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে রুয়েট কর্তৃপক্ষ। এর তদন্ত চলমান। তবে এনিয়ে স্বস্তিতে নেই অনেক শিক্ষক-কর্মচারী। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ নিয়ে দিনগুজরান চলছে তাদের। নিজেদের মধ্যে নানান স্বার্থ নিয়ে রেশারেশিই এর কারণ বলে জানা গেছে।
দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: পর পর দু’জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা রুয়েটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার প্রকাশ ঘটায় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। গত ১৭ মে দুপুরে লেফটেন্যান্ট সেলিম হলের নিজ রুমে শিক্ষার্থী তানভীর ফাহাদ রুমি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত শিক্ষার্থীর বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল বিভাগের ১৮ সিরিজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনদিনের ব্যবধানে ২০ মে রাত ১২টার দিকে নগরীর সাধুর মোড় এলাকার রহিম লজ ছাত্রাবাসের নিজ রুম থেকে সামিউর রহমানের লাশ গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সামিউর রুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ১৭ সিরিজের ছাত্র ছিলেন।
রাজনৈতিক উত্তেজনা: বাইরের রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস সাধারণত তেমন প্রতিক্রিয়ায় জড়ায় না। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি দিয়ে এধরনের ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। সম্প্রতি রাজশাহীতে বিরোধীদলীয় একজন নেতার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে অন্য কোথাও না হলেও রুয়েটের ক্যাম্পাসে এমন প্রতিক্রিয়া দেখানোয় সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের দাবিনামা: রুয়েটের শিক্ষার্থীরাও তাদের কল্যাণের জন্য আন্দোলন করে আসছেন। যেসমস্ত দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছেন তার মধ্যে রয়েছে:
১. যেকোন পরীক্ষার খাতায় কোডিং সিস্টেম এর মাধ্যমে একজন পরীক্ষক যেন কোনক্রমেই পরীক্ষার্থীর পরিচয় জানতে না পারেন এবং নিরপেক্ষ নম্বর প্রদান করেন তা নিশ্চিত করতে হবে। ২. শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল সর্বসমক্ষে প্রকাশ না করে প্রত্যেকের নিজস্ব আইডি/মেইলে প্রদান করতে হবে। ৩. সম্ভাব্য মানসিকভাবে ভঙ্গুর শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা এবং সেটা অবশ্যই শিক্ষক ব্যতীত কোন তৃতীয় পক্ষ হতে হবে। ৪. শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষকদের শিক্ষাদান এবং ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক বিষয়ে নিয়মিত মূল্যায়ন গ্রহণ এবং তার উপর ভিত্তি করে শিক্ষাসুলভ পরিবেশ তৈরির জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৫. যে কোন কোর্সে ৪০% এর বেশি পরীক্ষার্থী ব্যাকলগ (৪০% এর কম নম্বর) পেলে পরীক্ষার খাতা পুনরায় মূল্যায়ন/পুনঃপরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৬. প্রত্যেক পরীক্ষার্থীদের ফল প্রকাশ করার পর তাদের পরীক্ষার খাতা দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ৭. ব্যাকলগ পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি আরো সহজতর করতে হবে। প্রতি ২ সেমিস্টার পরে ৩টি ব্যাকলগ পরীক্ষার বদলে ৫টি ব্যাকলগ পরীক্ষা প্রদানের সুযোগ দেয়া এবং যেকোন ব্যাকলগ পরীক্ষার স্লট এ পূর্ববর্তী যেকোন ব্যাকলগ-এর জন্য রেজিস্ট্রেশন-এর সুযোগ প্রদান করতে হবে। ৮. পরীক্ষা শেষ হবার ২ সপ্তাহের মাঝে ফলাফল প্রকাশ এবং বিজোড় সেমিস্টার-এর ৫ সপ্তাহের মাঝে ব্যাকলগ পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন করতে হবে। ৯. ক্যাম্পাস এরিয়ায় কোন ছাত্রের যেকোন অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রশাসনিকভাবে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মৃতের পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদান করতে হবে। ১০. অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে এককালীন ও মাসিক আর্থিক অনুদান প্রদান করতে হবে। ১১. গবেষণা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকে অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্থিক অনুদান এর ব্যবস্থা করতে হবে। ১২. শিক্ষার্থীদের রুয়েটে শিক্ষাজীবন শেষে ক্লিয়ারেন্স সংক্রান্ত জটিলতা লাঘব করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে একধাপে ক্লিয়ারেন্স সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে। ১৩. রুয়েট মেডিকেল সেন্টারে ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে রুয়েট মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসার অপ্রতুলতার কারণে কোন শিক্ষার্থীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি করার প্রয়োজন হলে রুয়েট প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।