মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহ। এরই মাঝে দেশজুড়ে ঘন ঘন লোডশেডিং অতিষ্ঠ করে তুলছে জনজীবন। জানা যায়, জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপন্ন করায় দেশজুড়ে আবারও লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। তীব্র গ্যাস সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে দেশের শিল্প, কল-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোডশেডিং এবং গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে, বিভিন্ন শিল্পখাতের উৎপাদনশীলতা অর্ধেক কমে গেছে।
পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে দৈনিক ১৫,৫০০ থেকে ১৬,০০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ২৪,১৪৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু দেশে উৎপাদন হচ্ছে ১৪,০০০ থেকে ১৪,৫০০ মেগাওয়াটের মতো। ফলে চাহিদার তুলনায় দৈনিক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ মেগাওয়াট।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কম উৎপাদনের কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলো এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুতের এই ঘাটতি সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি দেশজুড়ে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ জনগণ। কিছু কিছু এলাকায় দিনে আট ঘন্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। এমনিতে গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহ, তার ওপর তীব্র লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে জনজীবন। এমনকি শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকবার লোডশেডিং হয়েছে। প্রতিবারই অন্তত এক ঘণ্টার জন্য স্থায়ী হয়েছিল লোডশেডিং। অথচ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাধারণ সময়ের তুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা থাকে অনেকটাই কম।
রাজধানীর বাসিন্দারা জানান, শুধু সকালেই দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হয়েছে। এরপর দুপুর থেকে রাত কিছুক্ষণ পর পর হচ্ছে লোডশেডিং। ছোট ব্যবসায়ীরাও চিন্তিত। এমনকি রেস্তোরাঁর ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত; কারণ লোডশেডিংয়ের ফলে তারা ঠিকমতো রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করতে পারেছেন না। অন্যান্য জেলাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহের একই অবস্থার কথা জানা গেছে। জেলা শহরের বাসিন্দারা জানান, গরম বাড়লেই লোডশেডিং শুরু হয়। এলাকাভেদে দিনে চার থেকে ১০ বার বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে বা সরবরাহ বন্ধ থাকছে। কিন্তু অনেক সময় মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ আসে এবং চলে যায়।
এতে ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাপদাহের মধ্যে বিদ্যুতের ঘনঘন যাওয়া-আসার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে শহর-গ্রামের জনজীবন। শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষের কষ্ট বেড়েছে।
এদিকে, পিডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলমান বিদ্যুৎ সংকটের কোনো আশু সমাধান নেই; কারণ জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করতে পারছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের কাছে থাকা সব বিকল্প আমরা ব্যবহার করছি। জ্বালানি ঘাটতির কারণে আমরা আমাদের প্ল্যান্টের সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছি না।
শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোডশেডিং এবং গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে, বিভিন্ন শিল্পখাতের উৎপাদনশীলতা অর্ধেক কমে গেছে। গ্যাস-চালিত শিল্পগুলো তাদের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সরবরাহ পাচ্ছে না; অন্যদিকে, অন্যান্য অনেক শিল্প লোডশেডিং ও ভোল্টেজের ওঠা-নামার মাঝে তাদের আংশিক উৎপাদনশীলতাও বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক মোঃ রুহুল আমিন জানান, নরসিংদীতে তার স্পিনিং মিল প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। স্পিনিং মিলসহ ব্যবসা পরিচালনায় প্রায় ৫২ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে বিনিয়োগকারী খোরশেদ আলমের। তিনি জানান, এমন গ্যাস সংকট তিনি আগে কখনো দেখেননি। আমার কারখানার একটি উৎপাদন লাইন ইতোমধ্যেই বন্ধ রয়েছে, অন্য ইউনিটগুলো সক্ষমতার ৩০ শতাংশে কাজ করছে। খোরশেদ আলম আরও বলেন, আমরা দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ পাই।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, বর্তমানে এই খাতের বেশিরভাগ কারখানায় উৎপাদন গড়ে ৫০ শতাংশ ক্ষমতা নিয়ে চলছে। আবার অনেক টেক্সটাইল কারখানার উৎপাদন তাদের ক্ষমতার ৩০ শতাংশেও নেমে এসেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে বাজে অবস্থায় আছে। এমনকি, গুলশান ও বনানীর মতো এলাকাগুলোতেও তীব্র লোডশেডিং হচ্ছে। বারবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে আমরা এই সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি। বর্তমানে বিদ্যুতের দাম ২০১০ সালের তুলনায় ১৬০.৪৬ শতাংশ বেশি। তিনি বলেন, সম্প্রতি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তার কারখানার মাসিক গ্যাসের বিল বেড়েছে গড়ে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা, যা আগে ছিল ৩৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন জানান, সিরামিক কারখানাগুলো উৎপাদন কার্যক্রমের জন্য গ্যাসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হলেও তারা দিনের বেলায় ন্যূনতম সরবরাহ পাচ্ছে। রাতে তারা মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বেশি পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ পায়। কিন্তু এই গ্যাস আদতে ৫০ শতাংশ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করা কারখানাগুলো সচল রাখার জন্যেও যথেষ্ট নয়।
এদিকে চলতি বছর প্রথমবারের মতো জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ গত ২৯ মে ৩,১০০ এমএমসিএফ অতিক্রম করে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এবারই প্রথমবারের মতো কক্সবাজারে ভাসমান স্টোরেজ এবং রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটগুলো সম্পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করে এবং গ্রিডে প্রথমবারের মতো ৯৮০ এমএমসিএফ এলএনজি যুক্ত করে। একইদিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১,২০০ এমএমসিএফ গ্যাস পেয়েছে বিদ্যুৎ খাত; এটিও একটি রেকর্ড। দেশের ৬৯টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটিতেই ওইদিন প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে ফার্নেস অয়েল এবং কয়লা-ভিত্তিক প্ল্যান্টে উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্যাস চালিত প্ল্যান্টে রেকর্ড পরিমাণে উৎপাদন সত্ত্বেও সর্বোপরি বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কারখানাগুলো প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহে জ্বালানি ঘাটতির কারণে ৬৪টি ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক প্ল্যান্টে মোট উৎপাদন দিনে মাত্র ১,৫০০ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে প্রায় ২,৫০০ মেগাওয়াট ছিল।
এদিকে বেসরকারিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা প্রায় পাঁচ মাস ধরে বিল না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি সংগ্রহেও ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের পাওনা ছিল ১৮,০০০ কোটি টাকা। বাইরে দাবদাহ। ঘরে অসহনীয় লোডশেডিং। দুইয়ে মিলে নাকাল জনজীবন। এতে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবারই অবস্থা করুণ। গ্রাহকরা জানান, এক ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ যাচ্ছে। তীব্র গরমের পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার মূল শর্ত পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান নিশ্চিত করা। তবে জ্যৈষ্ঠের গরমে ঘরে-বাইরে যখন এমন নাজেহাল পরিস্থিতি, তখন বিদ্যুৎখাত নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। দেশে বিদ্যুৎ সক্ষমতার ৪৭ শতাংশই গ্যাসনির্ভর হলেও, চাহিদার বিপরীতে অর্ধেক জোগান দিতে পারছে পেট্রোবাংলা। ফলে গ্যাস সংকট আর রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বন্ধ দেশের প্রায় ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর এসব কারণেই ২৫ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা থাকলেও ১৬ থেকে ১৭ হাজারের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে দিনে লোডশেডিং করতে হচ্ছে দেড় থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট। তবে সামনে অপেক্ষা করছে আরও খারাপ সময়। কয়লা সংকটে ধুঁকতে থাকা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দু-এক দিনের মধ্যে, যা চালু হতে অপেক্ষায় থাকতে হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজেই গতকাল শনিবার বলেছেন, কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়েছে। বর্তমানে ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং চলছে। কয়লা আমদানি করতে আরও অন্তত ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগবে।
পেট্রোবাংলা এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, অপ্রতুল স্থানীয় জ্বালানি, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি এবং অর্থ-ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানিতে ঘাটতি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে। চলতি মাসে এটি ২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। ঘাটতি আরও বাড়তে পারে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন সম্প্রতি বৃদ্ধি না পেলে সংকট আরও গভীর হতে পারতো বলে মনে করছেন তারা। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ১৮ হাজার কোটি টাকার বিল বকেয়া পড়ে রয়েছে। সরকার এ বকেয়া শিগগিরই কমিয়ে না আনলে কয়েকটি কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে কয়েকটিতে উৎপাদন কমে এসেছে।
বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানের নাজুক পরিস্থিতির জন্য নীতি নির্ধারকদের ভুল নীতিকে দায়ী করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এজাজ হোসেন। তিনি বলেন, গত বছরও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ভালো পাওয়া গিয়েছিল। তবে কয়লার জোগান নিশ্চিত করতে না পারায় বন্ধ হওয়ার পথে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। আগে থেকে পরিকল্পনা করে কয়লা আমদানি করলে এ সমস্যায় পড়তে হতো না। ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিশ্ববাজারে এখন তেল-কয়লা-এলএনজির দাম কমে গেছে। খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানির খরচ চুক্তিকৃত মূল্যের চেয়েও কম পড়বে। তাই শুধু দামের কারণে এ সংকট এখন থাকা উচিত নয়।