গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জন্য ৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার যে উচ্চাকাক্সক্ষী ঋণ নির্ভর বাজেট পেশ করেছেন সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম ৩ জুন ২০২৩ এক বিবৃতি প্রদান করেছেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, “গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী জনাব আ.হ.ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার যে বিশাল বাজেট পেশ করেছেন তা মূলত একটি ঋণ নির্ভর ঘাটতি বাজেট। বাজেটের শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে।’ বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে যে, এ বছরের বাজেটে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মানবসম্পদ ও শিক্ষা খাতের ওপর। অর্থমন্ত্রীর এসব উন্নয়নের বুলির সাথে আসলে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ, আর বাজেট ঘাটতি হচ্ছে জিডিপির ৫.২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেট এবং প্রবৃদ্ধির হার বাস্তবতা বিবর্জিত ও কল্পনা নির্ভর। বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। বাজেটে করের আয়তন বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ধনীদের জন্য বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলেও নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সিপিডির বক্তব্য অনুযায়ী এটি একটি গোঁজামিলের বাজেট। মূলত সরকার এ বাজেটের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে চায়।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট এডিপি ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৬৩ হাজার কোটি টাকা, রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে (বৈদেশিক অনুদানসহ) ৫ লক্ষ কোটি টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা আমদানি-রফতানি খাত থেকে, ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা মূল্য সংযোজন কর থেকে ও ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা আয়কর থেকে আদায় করার কথা ছিল। কিন্তু ঐ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আমদানি-রফতানি খাত থেকে এসেছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা, ভ্যাট আদায় হয়েছিল ৯৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা ও আয়কর থেকে এসেছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি খাতেই ঘাটতি রয়ে গেছে।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বিশাল এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বিশাল এই ঘাটতি মেটাতে আগামী বাজেটে সরকার বৈদেশিক ঋণ নেবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ ছাড়াও সরকার দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশই ঘাটতি রয়েছে। বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঋণ পরিশোধ করতেই চলে যাবে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। গত বছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭.২। যা গত অর্থ বছরে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশার বাণী শোনালেও তা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত ভঙুর। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা নেই। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নেই। বিনা চিকিৎসায় বহু মানুষের মৃত্যু ঘটছে। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা। যা প্রস্তাবিত বাজেটের মোট ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। আমরা মনে করি দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাজেটের মোট ১০ শতাংশ হওয়া উচিত।
কৃষিখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। কৃষিই হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কৃষকরা বরাবরই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়না। এবছর ধানের ফলন ভালো হলেও কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য পায়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে উৎপাদনের উপকরণের মূল্য হ্রাসের কোনো কথা বলা হয়নি। রাসায়ণিক সারের মূল্য কমানো, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাসহ কৃষিখাতকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়নি।
বাংলাদেশে শিল্পখাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে। পর্যাপ্ত জ্বালানির অভাবে শিল্পখাতে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পে প্রায় তিন কোটি মানুষ সম্পৃক্ত। এ খাতকে প্রস্তাবিত বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বাজেটে দেশের আবাসন শিল্পখাতে কর দ্বিগুন করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা এখাতকে আরো সংকটে ফেলে দিবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে তা ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ইউনেস্কোর পরামর্শ অনুযায়ী একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
বাজেটে কয়েক বছর পর করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। আমরা মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়ের সীমা অন্তত ৪ লক্ষ টাকা হওয়া উচিত। এছাড়া বাজেটে সরকারি-বেসরকারি খাতে ৪৪ ধরনের সেবা পেতে করযোগ্য আয় (বার্ষিক সাড়ে ৩ লাখ টাকা) না থাকলেও আগামী অর্থবছর থেকে ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর দিতে হবে। অসচ্ছল, মধ্যবিত্ত মানুষকেও সেবা পেতে এ কর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে এতে করমুক্ত আয়ের নিচে যাদের অবস্থান তারা আয়কর রিটার্ন জমা দিতে নিরুৎসাহিত হবে।
বাজেটে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। আমরা মনে করি বিদেশে পাচার করা টাকার মালিক জনগণ। জনগণের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যারা জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে এবং অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দের কথা বলা হয়নি। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্য বীমার জন্য বাজেটে কার্যকর ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি।
দেশের এ বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং সকল স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সর্বোপরি বলা যায়, এ ঋণনির্ভর ঘাটতি বাজেট সার্বিকভাবে দেশের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না।