মানুষ ঘামছে আর ঘামছে। তীব্র গরমে শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে জামা কাপড় ভিজে অস্বস্তি তৈরি করছে। রাস্তা-ঘাটে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালত সবখানে মানুষের শরীর থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। কাজ রেখে মানুষ ব্যস্ত ঘাম মুছতে। ফ্যানের বাতাসেও ঘাম ফিরাতে পারছে না। যারা এসি রুমে থাকেন তাদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও এসি থেকে বের হলেই বিপদ। এক ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছ গায়ের জামা-কাপড়। প্রচণ্ড গরম দুর্বিষহ করে তুলেছে জনজীবন। এর সঙ্গে দফায় দফায় লোডশেডিং ভোগান্তিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। গরম আগামী তিনদিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
জ্যৈষ্ঠের খরতাপে তীব্র গরম বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূর্য তেঁতে ওঠায় কয়েকদিন ধরেই তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ। ঘরে বাইরে সবখানে তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন মানুষ। দিনের বেলায় কাঠফাঁটা রোদ থেকে বাঁচতে অনেক গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলেও লু হাওয়ায় সেখানেও মিলছে না স্বস্তি। শ্রমজীবী আর গণপরিবহনের যাত্রীদের অবস্থাও সঙ্গীন। ঘামে ভেজা মানুষ খানিকটা স্বস্তির খোঁজ করলেও মিলছে না। ঘর থেকে বের হলেই হাসঁফাঁস অবস্থা মানুষের। সারাদেশে এমন অবস্থা আরও কয়েকদিন বিরাজ করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, দেশের যে সকল এলাকায় গতকাল তাপমাত্রা যেমন ছিল, আজও তেমনই থাকতে পারে। আগামী তিনদিন সারাদেশের চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এদিকে তীব্র গরমের মধ্যে যোগ হয়েছে লোডশেডিং। তাও আবার গভীর রাতে বিদ্যুত চলে গেলে ঘুম ভেঙে যায়। হাত পাখায় মানুষের শরীর ঠা-া করতে পারে না। তখন মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। অতিরিক্ত গরমে মানুষের শরীরে পাণি শূন্যতা দেখা দিচ্ছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। বিশেষ করে যারা শ্রমসাধ্য কাজ করেন তারা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে জানা গেছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশের ৪ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, যা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃহস্পতিবার দিনাজপুরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গতকাল শুক্রবার আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও সৈয়দপুরের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং সিলেট, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলাসহ ঢাকা, ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগ এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা বাড়তে পারে। তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারা দেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
১ জুন দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল দিনাজপুরে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঢাকায় ছিল ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া গতকাল রাজধানী ঢাকার সারাদিনের আবহাওয়া ছিল হাপিয়ে ওঠার মতো। ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশ ভুগিয়েছে বাইরে বের হওয়া মানুষদের। আজও একই অবস্থা। সকাল থেকে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। এদিকে অফিসগামী মানুষ গরম উপেক্ষা করে সকালে অফিসে পৌঁছালেও ভাল নেই, দিনমজুর শ্রেণির মানুষ। রিকশা চালক, পরিবহন শ্রমিক, রংমিস্ত্রী, ঢালাই শ্রমিক থেকে শুরু করে ফুটপাতের ব্যবসায়ী এমনকি ভিক্ষুকরাও নাকাল হয়ে পড়েছেন তীব্র গরমে। পথের পাশে একটু ছায়া পেলেই সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছেন মানুষ। উত্তাপের কারণে ঘরের ভেতরেও থাকা কষ্টকর হয়ে গেছে। ফ্যান থাকলেও গরম বাতাসে গা ভিজে যাচ্ছে। দিনের বেলায় বাইরে থাকা আরও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গরমের কারণে বেশি সময় যাত্রী পরিবহন করতে পারছেন না রিকশাচালকরা। দীর্ঘ সময় বিশ্রাম নিয়ে যাত্রী পরিবহন করতে চাইলেও ভাড়া হাঁকছেন বেশি। রিকশা চালকদের ভাষ্য, গরমের কারণে তাদের মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম হচ্ছে।
তাপমাত্রা কমতে পারে ২৪ থেকে ২৫ তারিখের পর। বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট একটু লঘুচাপ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে ২৬ তারিখের দিকে দেশের উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে। তার আগে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের মধ্যে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়া অফিস আরও জানিয়েছে, মে মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। জুন মাসেও সামগ্রিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সারাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু (বর্ষাকাল) বিস্তার লাভ করতে পারে। এছাড়া জুন মাসে অব্যাহত থাকতে পারে তাপদাহের দাপট।
পূর্বাভাস অনুযায়ী, জুন মাসে বঙ্গোপসাগরে এক-দুটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি মৌসুমী নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। এ মাসে দেশে চার-ছয়দিন হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বজ্রঝড় হতে পারে। পূর্বাভাসে আরও বলা হয়, এ মাসে দেশে এক-দুটি বিচ্ছিন্নভাবে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে এবং দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছুটা বেশি থাকতে পারে। দেশের নদ-নদীর অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, জুন মাসে ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের কতিপয় স্থানে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
খুলনা ব্যুরো : অস্থির তীব্র তাপদাহ শুরু হয়েছে। কয়েকদিন ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে তাপমাত্রার পারদ। প্রতিদিন তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। অসহনীয় অগ্নিদহনে প্রাণহীন হচ্ছে চারপাশের প্রকৃতি। অস্থির গরমে নাজেহাল জীব-বৈচিত্র, মানুষ-জীবকূল। দিনে মাথার উপর তপ্ত সূর্য, আর রাতের বেলায় ঘরের ভেতর গরম বাতাসের ভ্যাপসা অনুভূতি। স্বস্তি নেই দিনে বা রাতে, নেই ঘরে বা বাইরে, কোথাও। তীব্র এই গরমের মধ্যে আবার শুরু হয়েছে ঘন ঘন বিদ্যুৎতের লুকোচুরি। দুপুর, সন্ধ্যা বা গভীর রাতে প্রচন্ড গরমের মধ্যে দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে পড়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে খুলনাঞ্চলের জনজীবন। একদিকে গরম, অন্যদিক লোডশেডিং, সীমাহীন দুই কষ্টের মধ্যে সময় কাটাচ্ছে তারা।
খুলনা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট বিভাগসহ দেশের অনেক জায়গায় মৃদু হতে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহের কারণে এবং সূর্যের কিরণের তীব্রতার কারণে, সাথে সাথে বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে গরমের তীব্রতা অনুভূত হচ্ছে। আগামী ৪/৫দিন পর বৃষ্টি হলে গরমের তীব্রতা কমে যাবে। প্রচন্ড গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে এই অঞ্চলের মানুষের। বাইরে বের হলে আগুনের ফুলকি যেন সোজা চোখে মুখে আঘাত করছে। তীব্র গরম পেরিয়ে কর্মজীবীরা তাদের কর্মস্থল হতে বাড়ীতে ফিরে স্বস্তি খুঁজলেও বিদ্যুৎতের লুকোচুরির কারণে গরমে সম্পূর্ণ কুপোকাত।
নগরীর দৌলতপুর এলাকার বাসিন্দা চাকরিজীবী সাইফুল্লাহ জানান, কয়েকদিন আগে বৃষ্টি হলেও, আবারও ব্যাপক গরম পড়া শুরু করেছে। এর মধ্যে আবার দিনরাত জুড়ে কয়েক দফায় বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। সকাল ৯টা বাজতেই সোজা অফিসে চলে যেতে হয়, আসি রাতে। রাতের বেলায় দু’ এক বার বিদ্যুৎ যাবেই। গরমে অস্থির হয়ে উঠি। প্রচন্ড এই গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ ছাড়া থাকা দায় হয়ে পড়েছে। অস্থির গরমে ফ্যান চালিয়েও ঘরে থাকা যায় না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকলে মনে হয় আজাব যেন শুরু হলো।
মাহেন্দ্রা চালক মকবুল হোসেন জানান, বর্তমানে বাইরে সূর্যের অনেক তাপ। রোদে সারা শরীর পুড়ে যায়। ভোর থেকে সকাল ১০ টা পর্যন্ত আর বিকেল ৫টার পর থেকে গরম কিছুটা কম থাকে। সকাল ১০টার পর থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রচন্ড তাপদাহ থাকে। মনে হয় যেন চামড়া পুড়ে যাবে। শরীর ঘেমে যায়, শরীর দুর্বল হয়ে আসে। গাড়ি চালাতে অনেক কষ্ট হয়। দুপুরে খাবার সময় বাড়ীতে গিয়ে দেখি কারেন্ট নেই। যায় আর আসে। কারেন্ট চলে গেলে বাচ্চা-কাচ্চা ঘেমে একাকার হয়ে যায়।
নগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মইনুল ইসলাম জানান, বর্তমানে এতো গরম যেন বাতাসে আগুন উড়ছে। গরমের সাথে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এই গরমে বাইরে যেমন বের হওয়া যাচ্ছে না, তেমনই ঘরেও অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে।
নগরীর স্যার ইকবাল রোডের বাসিন্দা গৃহিণী আছিয়া বেগম জানান, বয়স হয়ে গিয়েছে। গরম সহ্য করতে পারি না। বার বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে, বাইরে বাতাসও নেই, যে বাতাসে গিয়ে বসে থাকবো। গরমে জীবন বের হয়ে আসে। কোথাও স্বস্তি নেই।
চাকরিজীবী মাসুদ রানা জানান, কর্মব্যস্ততা শেষ করে বাসায় ফিরে যে কোথায় স্বস্তিতে থাকব, সেখানে দিনে ও মধ্যরাতে ঘনঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এই গরমে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, খুলনাসহ কয়েকটি বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু ও মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা আরও ২/৩ দিন অব্যাহত থাকবে। এরপর বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমে যাবে।