বর্তমান বিশ্বকে গণতান্ত্রিক বিশ্ব বলে মনে করা হলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের পথচলা মোটেই নির্বিঘ্ন হয়নি। গণতন্ত্র নিয়ে আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অল্প-বিস্তর প্রশ্ন থাকলে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা খুবই জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। আমরা অবাধ গণতন্ত্র চর্চার জন্য সর্বাত্মক মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়নি বরং রীতিমত কক্ষচ্যুতি ঘটেছে। এমতাবস্থায় দেশের কক্ষচ্যুত গণতন্ত্রকে কক্ষপথে ফিরিয়ে আনার জন্য বিরোধীদলগুলো দীর্ঘদিন আন্দোলন করছে। আর এই আন্দোলনকে বেগবান ও যৌক্তিক পরিণতি দেয়ার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র ভিসানীতি প্রণয়ন করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য এরচেয়ে অমর্যাদাকর কথা আর কী হতে পারে? কিন্তু এ বিষয়ে নির্বিকার আমাদের দেশের গণতন্ত্রের প্রতিভূরা। যা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য বেশ লজ্জার।
সাম্প্রতিক বিশ্বে গণতন্ত্র একটি অতিজনপ্রিয় শাসন পদ্ধতি। মূলত ‘গণতন্ত্র’ এমন এক শাসন পদ্ধতি যেখানে নীতিনির্ধারণ বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা থাকে। এই পদ্ধতিতে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ স্বীকার করা হয়। সঙ্গত কারণেই গণতন্ত্র আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর শাসন পদ্ধতি বলে মনে করা হয়। প্রচলিত গণতন্ত্রের কিছু নেতিবাচক দিক থাকলেও অপরাপর শাসন পদ্ধতি থেকে এই ব্যবস্থাকে উত্তম ও অধিকতর গতিশীল হিসাবে স্বীকৃত। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশে^ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের অবনোমন ঘটেছে।
মূলত, গণতন্ত্রের কথিত প্রতিভূদের হাত ধরেই বৈশি^ক গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বড় ধরনের অবনোমন হতে শুরু করেছে। বিখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২০ সালের শুরুতে প্রকাশিত গণতন্ত্র সূচকে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের পশ্চাৎপসারণ ঘটছে সারা বিশে^ই। ২০১৯ সালে বৈশি^ক গণতন্ত্রে বড়ধরনের অবনতি ঘটেছে। যা এখন একটি চলমান প্রক্রিয়ায় রূপ নিয়েছে। এতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা আরও খারাপ বলে দাবি করা হয়। ১৬৭টি দেশের ওপর চালানো বার্ষিক জরিপের ফলাফলে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ নম্বরে ওঠে আসে।
৪টি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। এগুলো হলো যেসব দেশে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র আছে তাদেরকে রাখা হয়েছে সবার শীর্ষে। এই ক্যাটেগরির নাম দেয়া হয়েছে ‘ফুল ডেমোক্রেসি’। এরপরে রয়েছে যেসব দেশে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে তাদের নাম। এই ক্যাটেগরিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘ফ্লড ডেমোক্রেসি’ হিসেবে। বাংলাদেশের নাম রয়েছে এই ক্যাটেগরিতে। এরপরে রয়েছে ‘হাইব্রিড রেজিম’। তারপরে অবস্থান করছে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে, এমন দেশের তালিকা। একে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘অথরিটারিয়ান রেজিম’ হিসেবে। অবশ্য কোন কোন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড রেজিম’ এ স্থান দেয়া হয়েছে।
মোট ৫টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-১. নির্বাচনী প্রক্রিয়া। ২. সরকারের কার্যকারিতা। ৩. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। ৪. গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ৫. নাগরিক স্বাধীনতা। এসব সূচকের ওপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে, ২০১৯ সারাবিশ্বে গণতন্ত্রের ক্ষয় হয়েছে। ২০০৬ সালে এই সূচকের প্রচলন করা হয়। তারপর থেকে ১০ পয়েন্টের মধ্যে গত বছরে সর্বনিম্ন ছিল বৈশ্বিক স্কোর। তা হলো ৫.৪৪। ১৬৭ টি দেশের মধ্যে মাত্র ২২টি দেশে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র ছিল বলে মনে করা হয় সূচকে। এসব দেশে বসবাস করেন ৪৩ কোটি মানুষ। কিন্তু, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বেশি এখনও বসবাস করেন কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে।
চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও ডিজিটাল নজরদারির মতো অন্যান্য নাগরিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ফলে দেশটির স্কোরের বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। ভারতের স্কোর ৩.৩২ থেকে কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২.২৬। রিপোর্টে বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়েছে ভারতীয় সরকার। এ ছাড়া আসামে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বের বাইরে রাখা হয়েছে। এরা বেশির ভাগই মুসলিম। যা সূচকের অবনমনে এটি ভূমিকা রেখেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বৈষম্যমূলকভাবে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয় নাগরিকত্ব সংশোধন আইন। এই প্রক্রিয়া ২০২০ সালের সূচকে দেশটির গণতন্ত্রের সূচকে আরও অবনোমন ঘটেছে।
সাব সাহারান আফ্রিকার ৪৪টি দেশের অর্ধেকই এই সূচকে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক শ্রেণিতে পড়েছে। এ অঞ্চলের ২৩টি দেশে গণতান্ত্রিক স্কোর কমে গেছে। উন্নতি হয়েছে ১১টি দেশে। এ জন্য দায়ী করা যেতে পারে ওই অঞ্চলে অগণতান্ত্রিক নির্বাচনকে। এমন বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে সেনেগালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। দেশটিতে ম্যাকি সাল-এর প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে।
ফ্রান্সে ইয়েলো জ্যাকেট বিক্ষোভের জবাবে ইমানুয়েল ম্যাক্রন ধারাবাহিকভাবে টাউন হল মিটিং আহ্বান করেন। এর নাম দেয়া হয় ‘গ্রেট ন্যাশনাল ডিবেট’। এতে অনলাইনে যুক্ত হন প্রায় ২০ লাখ নাগরিক। ফলে ফ্রান্সকে ‘পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের’ মর্যাদা ধরে রাখতে এই প্রচেষ্টা সহায়ক হয়েছে। দেশে উচ্চ পর্যায়ের অসমতা ইস্যুতে চিলিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়। সরকার সর্বনিম্ন বেতন বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিক্ষুব্ধদের সাথে সমঝোতা করে। একই সঙ্গে সরকার এ বছরে সেখানে একটি নতুন সংবিধানের ওপর গণভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু যথেষ্ট মূল্যের বিনিময়ে এসেছে এই সংস্কার। ওই বিক্ষোভে মারা গেছেন কমপক্ষে ২০ জন। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ডেমোক্রেসি ইনডেক্স-২০২০ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ১৬৫টি দেশ ও দু’টি অঞ্চলের মধ্যে ৭৬তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এবার বাংলাদেশের স্কোর ৫.৯৯। আগের বছরে ৫.৮৮ স্কোর নিয়ে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮০তম। তার আগের বছর ৫.৫৭ স্কোর নিয়ে অবস্থান ছিল ৮৮তম। প্রতিবেদন অনুযায়ী আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সূচকের তেমন হেরফের না হলেও ইষৎ উন্নতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই সাথে একমত হতে পারছেন দেশের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ।
ইআইইউ ২০০৬ সালে যখন প্রথম এই সূচক প্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬.১১। সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্ববাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে তা এক ধাক্কায় ৫.৫২ পয়েন্টে নেমে যায়। অন্যদিকে ২০২০ সালে এই সূচকে পুরো বিশ্বের গড় স্কোর আগের বছরের ৫.৪৪ থেকে কমে ৫.৩৭ হয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, ২০০৬ সালে সূচক প্রকাশের পর থেকে এটাই সবচেয়ে বাজে স্কোর।
মূলত, গণতন্ত্রের এই অবনমনের পেছনে মহামারির মধ্যে দেশে দেশে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের বিষয়টি বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০২০ সালের এই সূচক বলছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (৪৯.৪ শতাংশ) এখন গণতন্ত্র অথবা আংশিক গণতন্ত্র ভোগ করছে। এর মধ্যে পূর্ণ গণতন্ত্র উপভোগ করছে মাত্র ৪.৮ শতাংশ মানুষ।
নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারে সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক অধিকার এই পাঁচ মানদ-ে একটি দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১০ ভিত্তিক এই সূচক তৈরি করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। সব সূচক মিলিয়ে কোনো দেশের গড় স্কোর ৮-এর বেশি হলে সেই দেশে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। স্কোর ৬ থেকে ৮-এর মধ্যে হলে সেখানে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’, ৪ থেকে ৬-এর মধ্যে হলে ‘মিশ্র শাসন’ এবং ৪-এর নিচে হলে সে দেশে ‘স্বৈরশাসন’ চলছে বলে ধরা হয়।
৯.৮১ স্কোর নিয়ে এবারের তালিকার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। শীর্ষ দশে আরো আছে আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডস। যুক্তরাষ্ট্রের স্থান হয়েছে গতবারের মতোই ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের’ দেশের তালিকায়। তালিকার তলানিতে আছে উত্তর কোরিয়া। এ ছাড়া ডিআর কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সিরিয়া, চাঁদ, তুর্কমেনিস্তানকেও নিচের দিকে রাখা হয়েছে।
এদিকে ২০২২ সালে গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করা হলেও বিষয়টি মোটেই প্রশ্নাতীত হয়নি। এবারের সূচকে দুই ধাপ এগিয়ে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৩তম। সূচকে ১০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৯৯। বিশ্বের ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চল নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবারের সূচক।
লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘গণতন্ত্র সূচক ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদন এ তথ্য প্রকাশ করেছে। সূচকে বিশ্বের দেশ ও অঞ্চলগুলোকে পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা- চারটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। এবারের সূচকে পূর্ণ গণতন্ত্র বিভাগে ২৪টি দেশ রয়েছে। এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বিভাগে ৪৮, হাইব্রিড শাসনব্যবস্থায় ৩৬ এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় ৫৯টি দেশ রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর গণতন্ত্রের অবস্থা মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে পাঁচটি মূল বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়। সেগুলো হলো-রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক স্বাধীনতা, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও সরকারের কার্যকারিতা। প্রসঙ্গ, ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম। ওই বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৯৯। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৬তম। স্কোর ছিল একই।
গত কয়েক বছরের মতো বাংলাদেশ এবারও হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বিভাগে রয়েছে। এই বিভাগে রয়েছে সেসব দেশ যেগুলোর স্কোর ১০-এর মধ্যে ৪ থেকে ৬-এর মধ্যে। বাংলাদেশ এই বিভাগে রয়েছে সবার ওপরে। সবার নিচে রয়েছে মৌরিতানিয়া। এবারের সূচকে দেশটির অবস্থান ১০৮তম, স্কোর ৪ দশমিক শূন্য ৩। এই বিভাগের অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভুটান, ইউক্রেন, উগান্ডা, নেপাল ও পাকিস্তান। দেশগুলোর অবস্থান যথাক্রমে ৮৪তম, ৮৭তম, ৯৯তম, ১০১তম, ১০৭তম।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সংজ্ঞায় হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বলতে এমন ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। যেখানে শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দল ও বিরোধী প্রার্থীদের ওপর সরকারের নিয়মিত চাপের মধ্যে থাকে। তাছাড়া এই বিভাগের দেশগুলোর বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয়। হয়রানি ও চাপের মধ্যে থাকেন সাংবাদিকরা। এ ছাড়া এই ধরনের শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, দুর্বল আইনের শাসন ও দুর্বল নাগরিক সমাজ। অপরদিকে, এবারের সূচকে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বিভাগে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে-যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুর। দেশগুলোর অবস্থান যথাক্রমে ৩০তম, ৪০তম, ৪৬তম, ৫৪তম, ৬০তম, ৭০তম। সূচক অনুযায়ী এ বছর গণতন্ত্রের দিক থেকে শীর্ষ স্থানে রয়েছে নরওয়ে। দেশটির স্কোর ৯ দশমিক ৮১। এছাড়া নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয়, আইসল্যান্ড তৃতীয়, সুইডেন চতুর্থ এবং ফিনল্যান্ড পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের সূচক কিঞ্চিৎ ওঠানামা করলে আমরা যে এ বিষয়ে এখনও আমরা খাদের কিনারে রয়ে গেছি তা নিশ্চিত করে বলা যায়। ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উদার গণতান্ত্রিক সূচক এবং নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে’-সম্প্রতি এমন কথায় জানিয়েছে সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম)। যা আমাদের গণতন্ত্রের দৈন্যদশার প্রতিই অঙ্গুলী নির্দেশ করে।
গত পাঁচ বছর ধরে বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট। এবারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘অটোক্রাটাইজেশন গোজ ভাইরাল’। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদার গণতান্ত্রিক সূচকে (লিবারেল ডেমোক্রেসি ইনডেস্ক) ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪তম। স্কোর শূন্য দশমিক ১। গতবারের চেয়ে স্কোর কমেছে শূন্য দশমিক ০১৯।
প্রতিবেদনে ‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ (ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি ইনডেক্স) বাংলাদেশের অবনমন ঘটেছে। এই সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩৮তম, স্কোর শূন্য দশমিক ২৭। স্কোর কমেছে প্রায় শূন্য দশমিক ০৩১। এ ছাড়া লিবারেল কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬১তম। ইগলিট্যারিয়ান কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে ১৭৬তম, পার্টিসিপেটরি কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে ১৪৩ এবং ডেলিবারেটিভ কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে বাংলাদেশ ১৫৮তম অবস্থানে আছে। এতে বলা হয়, শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে বাংলাদেশ আছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ (ইলেকটোরাল অটোক্রেসি) বিভাগে। এর অর্থ হলো, এ দেশে গণতন্ত্র অপগ্রিয়মাণ। সে জায়গায় ধীরে ধীরে স্থান করে নিচ্ছে স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন।
ভি-ডেম বলেছে, নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র থেকে ভারত নেমে এসেছে নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্রের স্তরে। দেশটি গত ১০ বছরে ক্রমাগত গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে হাঁটছে এবং সেখানে সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকসমাজের স্বাধীনতা প্রচন্ডভাবে সংকুচিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার সঙ্গে এই অবনমনের সাথে সম্পর্ক রয়েছে বলে সংস্থাটি মনে করছে।
বস্তুত, বিশ্বজুড়েই স্বেচ্ছাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনের প্রভাব বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা চলছে পোল্যান্ডে। মহামারি সামাল দেওয়ার কথা বলে অনেক দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। ৯টি দেশে মারাত্মক ও ২৩টি দেশ আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিমিত মাত্রায় লঙ্ঘন করেছে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়েছে ঘোষিত একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোতে, ৫৫টি দেশেই আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন হয়েছে বেশি।
মূলত, বিশ্বজুড়ে শাসনকাঠামোর দিক থেকে নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে পুরোপুরি ও আংশিক স্বেচ্ছাতন্ত্রের দেশগুলোতে আছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। অথচ ২০১০ সালে এটি ছিল ৪৮ শতাংশ। আর উদার গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমে হয়েছে ৩২টি। মোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ রয়েছে এই দেশগুলোতে। ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি আছে ৬০টি রাষ্ট্রে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ আছে এসব দেশে।
ভি-ডেমের বার্ষিক গণতন্ত্র প্রতিবেদনে উদার গণতান্ত্রিক সূচকে শীর্ষ তিন স্থানে আছে যথাক্রমে ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে উদার গণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় আন্তর্জাতিক নিয়মের মারাত্মক লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহামারি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মোট দেশের দুই-তৃতীয়াংশেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক থেকে পরিমিত মাত্রায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ দেশে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ব্যতিরেকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করা এবং জরুরি ক্ষমতার অত্যধিক প্রয়োগ করা হচ্ছে।
মূলত, বিশ্বব্যাপী উদার গণতন্ত্রের ধারাবাহিক অবনমন হচ্ছে। বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশিয়া, মধ্য এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকায় এ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্রাজিল, ভারত, তুরস্কসহ মোট ১০টি দেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি অবনমন হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি দেশ হয়ে গেছে পুরোপুরি একনায়কতান্ত্রিক। যা আগামী দিনে বৈশ্বিক গণতন্ত্রকে বড় ধরনের সংকটে ফেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আসলে গণতন্ত্রের আহাজারী-আর্তনাদ ও সঙ্কট এখন বৈশ্বিক সমস্যা। কিন্তু আমাদের দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা একেবারেই ব্যতিক্রমী। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের। আর এ জন্যই প্রণীত হয়েছে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিনব ভিসানীতি। যা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য মোটেই সম্মানজনক হয়নি। এমনকি তা আমাদের স্বাধীন সত্তা ও স্বাধীনতার চেতনার জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়। মূলত, শ্রেণি বিশেষের ক্ষমতালিপ্সা ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা এজন্য প্রধানত দায়ী।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে আমাদের গণতন্ত্রের সূচক নিয়ে যে ওঠানামার রূপকথা শোনানো হয় তার সাথে একমত নন দেশের আত্মসচেতন মানুষ। এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলমের মন্তব্য খুবই চমকপ্রদ। তার মতে, ‘ভি-ডেমের মতো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সূচক দিয়ে অবস্থা দেখায়। আমরা তো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজ চোখে দেখছি, অনুভব করছি। আমরা প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিচে নামা প্রত্যক্ষ করছি। আমাদের গণতন্ত্র ছিল নির্বাচনসর্বস্ব। এটাও এখন নেই’। এখন বাংলাদেশের জন্য মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরাতে কতখানি ইতিবাচক ভূমিকা রাখে তা-ই দেখার বিষয়।