দেশে নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। ধরাও যায় না, ছোঁয়া ও যায় না। ধরলেই হাত যেন পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। আজ পেয়াজের দাম, কালকে লবণের দাম, পরশু চিনির দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। ফলে অধিকাংশ মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এককথায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার দিশেহারা। জিনিসপত্রের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার ফলে অনেকে বাজার কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে উন্নয়নের স্লোগান হালে পানি পাচ্ছে না, বাজিমাতও করা যাচ্ছে না। শুধু উন্নয়ন দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের তৃষ্ণা মেটেনা। দাম বাড়েনি এমন জিনিস খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। বানের পানির মতো পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। সরকার পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ রাখতে যেসব পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল তাও অসাধু ব্যবসায়ীরা মানছে না। পণ্য দ্রব্যের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎতের দাম কিছুদিন পর পর বাড়ানো হচ্ছে। ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে হাহাকার দেখা দিয়েছে। চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে তাঁদের জীবন। সম্প্রতি শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের দুটি বক্তব্য বেশ ভাইরাল হয়েছে। মন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছে। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘মন্ত্রীদের ভেতর একটা সিন্ডিকেট আছে। সব কথা বলতে গেলে দেখবেন আমার লাশটা রাস্তায় পড়ে আছে। (সূত্র : যুগান্তর ১৬.০৫.২০২৩) অসহায় মানুষের কষ্টের প্রতি বেদনাবোধ অনুভব করায় তাঁকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। ‘‘সম্প্রতি ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশ যুবমৈত্রী ও বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী আয়োজিত এক আলাচনা সভায় বক্তব্য প্রদানকালে বলেন, দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ নিম্নবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ গরিব হয়ে যাচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির কারণে এমনটি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, একদিকে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে হু হু করে। বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম। অন্যদিকে উন্নয়ন হলেও দুর্নীতি লুটপাটের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ টাকার পাহাড় গড়ছেন। ফলে মধ্যবিত্তরা নি¤œবিত্তের কাতারে আর নিম্নবিত্তরা গরিবের কাতারে। সীমাহীন বৈষম্যের কারণে মানুষ আজ পথহারা।’’
কমছে না সবজি, মাছ, গোশত কিংবা মসলার দাম। বিভিন্ন পদের মসলা ও মাছের অতিরিক্ত দামে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে আদা ও জিরার দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে। সাধ্যের মধ্যে পাঙ্গাস, সিলভার কার্প কিংবা তেলাপিয়া মাছও মিলছে না। যারা পাঙ্গাস কিংবা সিলভার কার্প মাছ দেখলে নাক ছিটকাতেন তারা এখন এসব মাছের ক্রেতা। বাজারে সচরাচর যাওয়া হয় না। পথের ধারে ফুটপাত থেকে বাজার করি। কিন্তু সেদিন রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগ কাঁচা বাজারে গিয়েছিলাম। ছোট এই বাজারে দুটি বিষয় চোখে পড়ল। প্রথমটি হচ্ছে নারীদের সরব উপস্থিতি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে একজন অসহায় ক্রেতার দরকষাকষির দৃশ্য। মাছ কিংবা গোশতের জন্য দরকষাকষি নয়! দয়কষাকষি হচ্ছে এক কেজি মাছের কলিজার জন্য। ভাবা কি যায়! মানুষের আর্থিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! সমাজে অনেকে মাছের কলিজা কিংবা মুরগির গিলা খায় না। কিন্তু ওই ভদ্রলোক এককেজি মাছের কলিজার জন্য বার বার দর কষাকষি করছেন। বিক্রেতা কোন মতেই দাম কমাতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু ক্রেতা বার বার অনুনয় বিনয় করছেন। বাজারে গেলে এমন হাজারো অসহায় মানুষের মুখ এখন দেখা যায়। অনেকের পক্ষে ১ কেজি পণ্য কিনা তো দূরের কথা ২৫০ গ্রাম সদাই ক্রয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ওইসব অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের যন্ত্রণা কত যে কষ্টের তা ভুক্তভোগী ব্যতিত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। এবার আসা যাক দ্বিতীয় ঘটনায়। ছোট এই বাজারে পুরুষের চেয়ে নারীদের সরব উপস্থিতি আমাকে অবাক করেছে। কারণ নারীদের নিরাপত্তার অভাব দেখে। পুরুষের সাথে ঠেলাঠেলি করেই নারীকে বাজার করতে হচ্ছে। যা দুঃখজনক। নারীর জীবন ও ইজ্জতের মূল্য অনেক বেশি। গণপরিবহনে নারী যেমন নিপীড়নের শিকার হয় তেমনিভাবে বাজারেও নারী নিপীড়নের শিকার। নারীদের জন্য নিরাপদ গণপরিবহন, নিরাপদ বাজার ও শপিংমল করা প্রয়োজন।
শিক্ষা, চিকিৎসা, বস্ত্র ও গণপরিবহন থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এটা বুঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের বাজার নিজে করলেই টের পাওয়া যাবে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে অনেকে ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছে। আবার অনেকে সংসারের খরচ জোগাড় করতে না পেরে চড়াসুদে ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে। উঁচু তলার বাসিন্দারা হয়ত ভালো আছে। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের হাহাকার কান পাতলেই শোনা যায়। সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর জরিপে তেমনটি উঠে এসেছে, প্রয়োজনের চেয়ে কম খাচ্ছেন ৭১ ভাগ মানুষ। আর ধার করে চলছেন ৭৪ ভাগ নিম্ন আয়ের মানুষ। জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ৩৭ ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবার একবেলা না খেয়ে থাকছেন। আবার অনেকে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছেন। দেশের গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর করা জরিপে ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে তাদের অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। (সূত্র নয়াদিগন্ত ৩০ মার্চ ২০২৩) ওই একই প্রতিবেদনে বলা হয় জরিপকারীদের কাছে ১৮ শতাংশ পরিবারের মানুষ জানিয়েছে যে, গত ৬ মাসে এমনও দিন গেছে যে পুরো দিন তাদের না খেয়ে থাকতে হয়েছে। ৩৫ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। নিম্ন আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসে যেসব পরিবর্তন এনেছেন তার কিছু অংশ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা প্রয়োজন। যেমন : নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় প্রায় ৯৬ শতাংশ মানুষ গোশত খাওয়া কমিয়েছে, ৮৮ শতাংশ মানুষ মাছ খাওয়া কমিয়েছে, ৭৭ শতাংশ মানুষ ডিম খাওয়া কমিয়েছে, ৮১ শতাংশ মানুষ তেল খাওয়া কমিয়েছে, ৩৭ শতাংশ মানুষ চাল খাওয়া কমিয়েছে, ৫৭ শতাংশ মানুষ আটা খাওয়া কমিয়েছে। সানেম বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ এখন ব্যাপক কাটছাঁট করছে। তাঁরা দেশের ৮টি বিভাগে গত ৯ মার্চ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত এ জরিপ চালিয়েছে। পাশাপাশি সানেম গ্রাম ও শহরের একটি তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করেছে। সানেমের ভাষ্যমতে গত ৬ মাসের ব্যবধানে গ্রামের তুলনায় শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো খাদ্যাভ্যাস বেশি কমিয়েছে। শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ যেখানে ৪১ শতাংশ চাল খাওয়া কমিয়েছে সেখানে গ্রামে ৩২ শতাংশ কমিয়েছে। শহরের ৬৫ শতাংশ যেখানে আটা খাওয়া কমিয়েছে সেখানে গ্রামে ৪৭ শতাংশ কমিয়েছে। ডাল খাওয়া শহরে যেখানে ৪৭ শতাংশ কমিয়েছে সেখানে গ্রামে ৪৩ শতাংশ কমিয়েছে। গোশত খাওয়া শহরে যেখানে ৯৭ শতাংশ কমিয়েছে সেখানে গ্রামে ৯৬ শতাংশ কমিয়েছে। মাছ খাওয়া শহরে যেখানে ৯০ শতাংশ কমিয়েছে সেখানে গ্রামে ৮৭ শতাংশ কমিয়েছে। ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে শহরের পরিবারগুলো যেখানে ৭৮ শতাংশ কমিয়েছে সেখানে গ্রামে ৭৬ শতাংশ কমিয়েছে। এক কথায় গত ৬ মাসে এসব পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১৩ শতাংশ। কিন্তু তাদের আয় বাড়েনি। (সূত্র ইত্তেফাক রিপোর্ট ৩০ মার্চ ২০২৩)
মানুষের জীবনযাত্রা দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের তকমা দিয়ে একশ্রেণীর মুনাফাখোর ইচ্ছেমত পণ্যের দাম বাড়িয়ে পকেট ভারী করছে। অনেকে কোটিপতি বনে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। সানেম এ রিপোর্ট হয়ত কারও কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! কিন্তু বাজারে গেলে টের পাওয়া যায় কত ধানে কত চাল। কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে না পেরে কলিজার টুকরা সন্তানকে শিশুশ্রমে নিযুক্ত করার কথা ভাবছে। এটা আমার কথা না। সানেম এর জরিপ বলছে ১৯ শতাংশ পরিবার এমনটিই জানিয়েছে। শুধু কি তাই! ২৪ শতাংশ পরিবার মনে করে ব্যয় কমাতে সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করা লাগতে পারে। এমনকি অনেকে মেয়ে সন্তানকে দ্রুত বিয়ে দেয়ার কথাও ভাবছে। কারণ সাধ্যে মিলছে না কোনো কিছুই। পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা এখন নিরুপায়। এ অবস্থা থেকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে বাঁচানোর স্বার্থে দুর্নীতি ও লুটপাটের লাগাম টেনে ধরতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের রুটকে চিরতরে বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক সুবিচার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষে জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার দ্রব্যমূল্যের পাগলাঘোড়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।