নদীকে পুকুর বানিয়ে সেই জমি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে নেওয়া হয়েছে ঋণ। নদীর জমি চলছে বেচাকেনা। দখলদারদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ সরকারি দপ্তরের চিঠি চালাচালিতে। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার নদী রক্ষায় এমন ব্যর্থতার কারণ হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলাকে দায়ী করেছেন পরিবেশবিদরা।
স্থানীয়রা জানান, এই নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় এক কিলোমিটার, দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার। ২৫ থেকে ৩০ বছর আগেও নদীটির পানি গিয়ে পড়ত ব্রহ্মপুত্রে। আশির দশকে দখলদারদের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে। নদীর বুকে রাস্তা নির্মাণ করায় স্থবির হয়ে যায় প্রবাহ। এর পর বাঁধ দিয়ে চলে পুকুর তৈরির প্রতিযোগিতা। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ‘নদীতে নেতাদের পুকুর’ শিরোনামে সমকালে সংবাদ প্রকাশ হয়। চলতি বছর চাকিরপশার নদীর ইজারা বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করা হয়েছে। সর্বশেষ গত মার্চে ১৪১ একর জলাশয় উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কাগজপত্রে উন্মুক্ত থাকলেও নদীটি এখনও প্রভাশালীদের দখলে। পানিতে নামলে জেলেদের মারধর করা হচ্ছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দেওয়া চাকিরপশার নদীবিষয়ক চিঠির উত্তরে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ২০২০ সালের ৫ মার্চ একটি চিঠি দেয়। ২২ জন দখলদারের নাম উল্লেখ করে ওই চিঠিতে জেলা প্রশাসক বলেছিলেন, ‘দখলদারদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলমান আছে।’ কিন্তু তিন বছরেও নদী দখলমুক্ত হয়নি, উল্টো প্রভাশালীরা আরও শক্তিশালী হয়েছে। দখলদারদের তালিকার ৭ নম্বরে আছেন রাজারহাট উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ইউনুস আলী। তাঁর দখলে ৩৪ একর জমি। বর্তমানে এসব জমির খাজনা আদায় ও খারিজ বন্ধ। ৩৪ একর জমিতে ছয়টি পুকুর তৈরি করেন ইউনুছ আলী। এতে প্রাচীর দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন কৃষি খামার। সেই জমি ২০১০ সালে বেসিক ব্যাংকের রংপুর শাখার কাছে বন্ধক রেখে ৮৫ লাখ টাকা ঋণ নেন। এই ঋণ সুদসহ ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা হয়েছে। বন্ধকি অবস্থায় ওই জমি সম্প্রতি ইউনুস আলী বিক্রি করেন সাফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে। রাজারহাট ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের তথ্য অনুসারে, জমি ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক এবং দুদকে অভিযোগ করেছেন চাকিরপশার সুরক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা।
এ বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের রংপুর শাখার ব্যবস্থাপক আবদুল কুদ্দুস সরকার বলেন, ‘২০১০ সালে ইউনুস আলী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। আমি গত জানুয়ারিতে এই শাখায় যোগ দিয়েছি। এ ঋণ দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারব। ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা জমি বিক্রির তথ্য প্রধান শাখায় জানাব। প্রধান শাখা থেকে যেভাবে নির্দেশানা দেবে সেভাবে কাজ করব।’
পরিবেশবিদরা বলছেন, দেশের সংবিধান, আইন এবং উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ি নদী কিংবা বিলের শ্রেণি পরিবর্তন এবং ব্যক্তিমালিকানায় নেওয়ার সুযোগ নেই। কোনোভাবে নদীর জমি ব্যক্তির নামে লেখা হলে তা বাতিল করতে হবে। কীভাবে এসব জমির মালিক হলেন– এ প্রশ্নে ইউনুস আলী বলেন, ‘এটা নদীর জমি কিনা জানি না। সিএস রেকর্ডে জলাভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে এই জমি নদীর। আমি জমি দখল করিনি, কিনেছি। জমির কাগজপত্র আমার কাছে আছে।’ জেলা প্রশাসনের দখলদারদের তালিকায় নাম আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসন তালিকায় মিথ্যা নাম দিয়েছে। তাদের তালিকায় থাকা অন্যদের কাছে জমি হস্তান্তরের জন্য চিঠি পাঠালেও আমাকে কিছুই জানায়নি।’
স্থানীয় জেলে আবুল কালাম বলেন, ‘ইউনুস আলী নদীর মূল প্রবাহ এলাকা দখল করে রেখেছেন। কিছু নিচু জমিতে তিনি ধান চাষ করেছেন। প্রভাব খাটিয়ে তিনি নদীর জায়গা দখল করে নিয়েছেন।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘নদীর জমি বিক্রির বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। নদ-নদী জনগণের সম্পত্তি, যা কোনোভাবেই হস্তান্তরযোগ্য নয়।’
২০২০ সালের ৫ মার্চ কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেওয়া এক চিঠিতে জানায়, চাকিরপশার নদীতে সরকারি জমির মোট আয়তন সিএস মূলে ৩০৬ একর। কিন্তু ২০২২ সালে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের একটি চিঠির সূত্রে জানা যায়, আরএস রেকর্ডে এই জমির পরিমাণ মাত্র ৩৬ দশমিক ২৮ একর। সিএস রেকর্ডে ৩০৬ একরের মধ্যে ২৬৯.৭২ একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জেলা প্রশাসনের চিঠিতে নদীটি বিল হিসেবে উল্লেখ থাকলেও ব্যক্তির নামে রেকর্ড করেছে। জেলা প্রশাসন অবৈধ দখল উচ্ছেদে আন্তরিক নয়। বরং কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় এসএ রেকর্ডে নদীর বেশ কিছু জমি দখলদারদের নামে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। দখলদারদের নামে জমির নাম জারিও হয়েছে। প্রশাসনের অবৈধ প্রক্রিয়ার কারণে নদীর জমি বারবার বিক্রির মাধ্যমে হাত বদল হয়েছে। তিনি বলেন, জনগণের আন্দোলনের ফলে বদ্ধ জলাশয় উন্মুক্ত করা হলেও দখলদারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি রিভারাইন পিপল এবং গণকমিটির সমনন্বয়ক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, চাকিরপাশার একটি প্রাকৃতিক প্রবাহ। উজানে এর নাম চাকিরপশার নদী, মাঝখানে নাম মরাতিস্তা নদী এবং ভাটিতে এর নাম বুড়িতিস্তা নদী। মধ্যবর্তী নাফাডাঙা, খালিসা, সদাগড়, চাকিরপশারপাঠক, চান্দামারী– এই পাঁচটি মৌজা বিল শ্রেণিভুক্ত। বিল অংশটিসহ উজানে এবং ভাটিতে নদীর ২০ কিলোমিটার প্রবাহ। অবৈধ দখলদারদের দ্রুত উচ্ছেদ করে নদীর প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
চাকিরপশার নদীটিতে প্রবাহ বাধাহীন করতে এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদে আটবার চিঠি দেয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। চিঠি দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়ও। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সে চিঠিতে যে স্থানে আড়াআড়ি সড়ক পানির প্রবাহ বন্ধ করেছে, তা অপসারণ করে নদীর প্রস্থ অনুযায়ী সেতু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার পরও নেই কোনো অগ্রগতি।
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরে তাসনিম জানান, বিলের অধিকাংশ জমি বন্দোবস্ত ও ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। উচ্ছেদ করতে গেলে আইন মেনেই এগুতে হবে। ভুলগুলো সংশোধন করতে হবে। তবে জমি কেনাবেচার বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সাইদুল আরিফ বলেন, চাকিরপশার নদী উদ্ধারে প্রশাসন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২২ জন দখলদারের বিরুদ্ধে প্রায় ১২৯টি মামলা দায়ের হয়েছে। আশা করছি শিগগির নদী উদ্ধার হবে।