মৌসুমের আগেই এবার ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে ডেঙ্গু। হাসপাতালগুলোতে বেড়েই চলেছে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত এ রোগীর সংখ্যা। এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১৭০৪ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক নিজেই জানিয়েছেন গতবারের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৫ গুণ। কীটতত্ত্ববিদরা এবছর অন্যান্য বছরের তুলনায় মশা বাহিত রোগী আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। নগরীর ডোবা নালা, ড্রেন ময়লা আবর্জনার ভাগারে পরিণত হওয়ায় এগুলো মশার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্পোরেশন নানা উদ্যোগ নিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দিন দিন বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বার বারই ব্যর্থ হচ্ছে। এর আগে মশা মারতে শুরু করা হয়েছিলো ড্রোন আর ব্যাঙের খেলা। যদিও তার আগে রাজধানীর মশা নিধনে ড্রেনে গাপ্পিমাছ অবমুক্ত, তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস চাষের উদ্যোগ নিয়েও কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জলাশয়ে মশার প্রজনন রোধ এবং লার্ভা ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়া হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে জলাশয়ের মশা মারতে পরীক্ষামূলকভাবে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে।
নগরবাসীর অভিযোগ, এর আগেও অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তখনো নানা ধরনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মেলেনি। মশক নিধনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না নিয়ে শেষ মুহূর্তে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়, যা আসলে কোনো কাজে আসে না। মশক নিধনের এসব উদ্যোগকে লোক দেখানো হিসাবেও অভিহিত করছেন অনেকেই।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশাবাহিত অন্যান্য রোগের তুলনায় বাংলাদেশে মূলত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর হিসেব করা হয়। প্রথম বছরেই ডেঙ্গুতে মারা যান ৯৩ জন এবং আক্রান্ত হন ৫ হাজার ৫৫১ জন। দেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। সেবছর সরকারি হিসেবে ডেঙ্গু জ্বরে ১৫৬ জনের মৃত্যু হয় এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ডেঙ্গুর পাশাপাশি দেশে ম্যালেরিয়া রোগের প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে কী পরিমাণ লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন তার প্রকৃত হিসেব পাওয়া যায় না। আমরা কেবল কয়েকটি হাসপাতালের তথ্য পাই। কিন্তু এর বাইরেও অসংখ্য রোগী অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেন এবং অনেকই বাসায় চিকিৎসা নেন। কেউ আবার পরীক্ষাই করান না। মশা নিয়ন্ত্রণে এখানে তেমন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয় না। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে ফুলহাতা শার্ট, হাতে পায়ে মোজা, দিনে মশারির ভেতর ঘুমানো এবং অফিসে প্রতিদিন সকালে অ্যারোসেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন কীটতত্ত্ববিদরা। পাশাপাশি যে এলাকায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে সেখানে ক্রাশ কর্মসূচি চালানোর কথা বলেন।
মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট কীটনাশক নেই। যে ফগিং করা হয় তাতে কিন্তু তেমন একটা মশা মরে না। এডিস মশার জন্য যে সব কীটনাশক প্রয়োজন তা নেই আমাদের। কিন্তু সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সেটি করা হয় না। ফলে মশা বাড়ছে। এমটাই বলছেন কীটতত্ত্ববিদরা।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এবার যে ধরন আমরা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে গত বছরের তুলনায়। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। এছাড়া আছে পানি প্রবাহের সিস্টেম এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। সব মিলিয়ে মৌসুম যেমন ছিল, সেটি হয়তো থাকবে না। ডেঙ্গুর পিক সিজন আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসকে ধরা হয়। কিন্তু গতবছর তার ব্যতিক্রম ছিল। পিক হয়েছিল অক্টোবর মাসে। মার্চে সার্ভে করা হয়েছিল এডিস মশার। তবে এখন সেটা অনেকখানি পরিবর্তন হয়ে গেছে, যার কারণে ডেঙ্গু বেড়েছে।
এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১৭০৪ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। রোগীর সংখ্যা গতবারের তুলনায় ৫ গুণ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে কোভিড টিকা এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাসপাতাল যাতে প্রস্তুত থাকে, চিকিৎসক এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। হাসপাতালে করোনা এবং ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে আড়াই হাজার নার্স-ডাক্তারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, ডেঙ্গু সচেতনতায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম এবং সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া হয়েছে। প্রচার প্রচারণার জন্য ব্যানার-পোস্টার তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সভা করা হয়েছে। যদি কোনো জরুরি ব্যবস্থা নিতে হয়, তার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। কেউ আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসুন। চিকিৎসা নিলে ডেঙ্গু ভালো হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে।
সারাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৭২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৫৮ জনই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। তবে এসময়ে নতুন করে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার একই সময়ের মধ্যে সারাদেশে নতুন করে আরও ৭২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৫৮ জন ঢাকায় চিকিৎসাধীন। বাকি ১৪ জন রাজধানীর বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে এই সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ২২৬ জন ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৩টি ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৯৮ জন। এছাড়া ঢাকার বাইরে ২৮ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১ হাজার ৮৪৩ জন। এরমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ১ হাজার ৬০৪ জন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩ জন।
প্রতিবছর বর্ষাকালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এরমধ্যে গত বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন।
এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশক নিধন অভিযান শুরু করেছে। গতকাল শুরু হয়ে ৫ জুন পর্যন্ত এই বিশেষ অভিযান চলবে। গুলশানস্থ বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ পার্কে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশক নিধন অভিযান উদ্বোধন করেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই আমরা নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ঘরে-ঘরে গিয়ে মশা মারা সম্ভব নয়। ডিএনসিসির প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশক নিধন অভিযান চলবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই অভিযানে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হবে। আমাদের মশক কর্মীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্কাউট ও বিএনসিসির সদস্যরাও মাঠে নামবে। শুধু সিটি করপোরেশন একা নয় বরং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবার সচেতনতা প্রয়োজন। জনগণ সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আমরা নিজেরাই এডিসের লার্ভার প্রজননক্ষেত্র তৈরি করি। বাসা বাড়িতে, ছাদবাগানে পানি জমিয়ে রেখে লার্ভা সৃষ্টি করছি। সিটি করপোরেশনের কর্মীদের পক্ষে বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে এসব লার্ভা ধ্বংস করা সম্ভব হয় না। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে আমরা ডিএনসিসির কাউন্সিলর ও কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিএনসিসি ও স্কাউটকে যুক্ত করেছি। আমি বিশ্বাস করি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ঢাকা শহরে গণপূর্ত অধিদফতর, রেলওয়ে, ওয়াসা, পুলিশ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অধিদফতর ও বোর্ড ইত্যাদি অনেক সংস্থার অনেক আবাসন ও স্থাপনা রয়েছে। নির্মাণাধীন প্রায় শতভাগ ভবনে মশার লার্ভা পাই। বিশেষ করে চৌবাচ্চাসহ অন্যান্য যেসব অবকাঠামো করা হয়, সেখানে পানি জমে থাকে। এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া রোগ হয়ে থাকে। যা অনেক সময় প্রাণহানি ঘটায়। সেজন্য আমাদের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বড় অংশই হলো এই ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করা, এডিস মশার বিস্তার রোধ করা। সেলক্ষ্যে যে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি তার অন্যতম হলো উৎস নিধন।