তেল, চিনি, আলু, পিয়াজ থেকে শুরু করে মসলা কিংবা মাংসসহ বাজারের প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই এখন চড়া। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মধ্যম ও স্বল্প আয়ের মানুষ। বর্তমান বাজারে সব ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। আবার কিছুদিন পরপরই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়িয়ে দেয়া হয় দাম। এমন বাস্তবতায় আসছে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট। প্রতি বছর বাজেট এলেই সব শ্রেণির মানুষের নজর থাকে কোন পণ্যের দাম কমলো, আর কোনটার বাড়লো। তবে বর্তমান মূল্যস্ফীতির চাপে নিত্যপণ্যের দামের দিকেই এবার নজর সবার। তবে বাজেটের আগে বাজারে সুখবর মিলছে না। বরং বাজেট পরবর্তীতেও বেড়ে যাওয়া পণ্যের দাম না কমার শঙ্কা ভোক্তাদের। তাদের দাবি, নিত্যপণ্যের দাম যদি সহনীয় মাত্রায় থাকে, তাহলেই বাজেট জনবান্ধব হবে।
তাই দাম নাগালে রাখতে নতুন বাজেটে নির্দিষ্ট ভোগ্যপণ্যে শুল্ক ছাড় দেয়ার দাবিও করছেন কেউ কেউ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের দরিদ্র মানুষ। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজেটে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা রাখার তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ ছিল, যা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশের চেয়ে বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল থাকায় বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি এতটা বেড়েছে। ফলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।
ওদিকে দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা ঠেকাতে ভর্তুকি বাড়ানোর দাবি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর তেল, পিয়াজ, চিনি, চাল, ডাল, সবজিসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। এখনো বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। সংসারে ব্যয় দ্বিগুণ হলেও আয় বাড়েনি। এমন অবস্থায় মানুষের সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, বাজার ব্যবস্থা চলে গেছে সিন্ডিকেটের দখলে। সরকার নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা কমাতে পারছে না। যদিও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। পণ্য আমদানি করে টিসিবি’র মাধ্যমে নিম্নবিত্তের কাছে কম দামে সরবরাহ করছে। চালু রয়েছে ওএমএস সেবাও।
বাজারের নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে এবারের বাজেটে ভর্তুকি বাড়ানোর পাশাপাশি যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না। তাই, সরকারের উচিত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিশেষ করে আমদানিনির্ভর পণ্যের ওপর থেকে শুল্ককর সরিয়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া সরকারের অর্থের জোগানের জন্য কর ফাঁকি দেয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তৌফিকুল ইসলাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নানা রকমের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাইরের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে। এতে মানুষের জীবনমানের অবনতি হয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী জ্বালানি থেকে ভর্তুকি উঠিয়ে দেবে সরকার। ফলে জ্বালানির দাম সামনে আরও বাড়বে। জ্বালানির দাম বাড়লে মধ্যবিত্তরা আরও চাপের মধ্যে পড়বে। কারণ সবকিছুর দাম বাড়তে থাকে। অন্যদিকে গত এক বছর ধরে টাকার মানের অবমূল্যায়ন হয়েছে। এতে আমদানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করতেই হবে। না হলে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
ওদিকে, বৈশ্বিক অবস্থার শিকার বাংলাদেশে পণ্যের দাম কমা নিয়ে নতুন কোনো সুখবর নেই বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক অবস্থার কারণে দেশে নিত্যপণ্যের দাম ও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। ফলে আমদানিকারকদের পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুর দাম বেড়েছে। ডলারের দাম কমানোর জন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখভাল করছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে কেবিনেটে আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশেও তেলের দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করা এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে সয়াবিন তেল বিক্রি করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম না কমা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে বলেও জানান মন্ত্রী।