সরদার আবদুর রহমান: উচ্চ আদালতের প্রদত্ত রায়ের একটি অংশ এবং আদালতে প্রদত্ত অ্যামিকাস কিউরিদের অভিমতের সূত্রে পুনর্বহাল হতে পারে কেয়ারটেকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা। এবিষয়ে রাজনৈতিক দল ছাড়াও বিশেষজ্ঞ পর্যায়েও এর পক্ষে দাবি জোরালো হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের শরীকসহ দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও আইন বিশেষজ্ঞদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানে এই কেয়ারটেকার সরকার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরকার তা সংবিধান থেকে তুলে দেয়। তবে এখন এই ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি আবারো জোরালো হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, সুপ্রিম কোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. আমীর উল ইসলাম সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা সত্ত্বেও কেয়ারটেকার সরকার ‘পুনরুজ্জীবন সম্ভব’ বলে অভিমত দিয়েছেন। তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালত সহায়ক আইনজীবী) হিসেবে মতামত প্রদানকারী ৮ জন আইনজীবীর অন্যতম ছিলেন। এই ৮ জনের মধ্যে তিনিসহ ৭ জনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এমনকি তৎকালীন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও আদালতে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। এখন ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম সেটিকে পুনর্জীবিত করা দরকার বলে মনে করেন। তাঁর মতে, সেটি ‘রিভাইব’ করে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা যেতে পারে। গত রোববার একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকারে এ অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবোধক’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোট চুরি একটি অপরাধ।’ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল আদেশের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। তাহলে কিভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা যাবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে হলে এর একটি ফ্রেম ওয়ার্ক থাকতে হবে। সেটিতো আমাদের নেই। সাধারণ মানুষ এটিকে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) অভিনন্দন জানিয়েছিল। সে জন্য এখন আমাদের ওই সময়কার যে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যে মতামত দিয়েছিলেন সেগুলোকে রিভাইব করা দরকার। সেটি করে একটি কেয়ারটেকার সরকার করা যেতে পারে। সেটি করলে জনগণের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে।”
এদিকে বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ আখ্যা দিয়ে এটি বাতিল করেন। এই রায়ের অসিলায় মহাজোট সরকারের উদ্যোগে সংসদে বিল উত্থাপন করে সংবিধান থেকে এই ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়। অথচ বিচারপতি খায়রুল হক যে রায় প্রদান করেন তাতে আরো দুটি মেয়াদে এই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করার অপশন রেখেছিলেন। কিন্তু মহাজোট সরকার তাতে আমল দেয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’র অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আবারো জোরালো হয়েছে। প্রধান প্রধান বিরোধী দল ও জোটগুলো এর পক্ষে উচ্চকিত হয়েছে। এমনকি সরকারের মিত্র জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও অন্তত ‘বিকল্প’ পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করেছেন। গত রোববার বিকেলে রংপুরে দলীয় কার্যালয়ে রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই দাবি করেন।
বাতিলের পক্ষে সাধারণ
ঐকমত্য ছিল না
২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক। রায় প্রদানকারী বাকি ৬ জন বিচারপতির মধ্যে ৩ জন তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন। ৩ জন দেন ভিন্নমত। রায়ে এই ব্যবস্থার আওতায় পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেয়া হয়। ওই সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলে, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের লেখা রায়ের সঙ্গে একমত হন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এই রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন। অর্থাৎ এই রায়টির পক্ষে ৪ জন এবং বিপক্ষে ৩ জন অভিমত দেন। এটি সর্বসম্মত ছিল না, বরং ছিল বিভক্ত রায়। ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এটি গৃহীত হয়। আদালতে যে ৮ জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করা হয় তাদের মধ্যে ৭ জনই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনৈক আইনজীবী ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট করলে এর প্রেক্ষিতে চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ রায় দেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে এই রায়ে বলা হয়, ‘১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত।’ ফলে দুই আদালতের বিচারপতিদের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে এর পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
অন্যদিকে ২০১০ সালের ২১ জুলাই প্রথম ১৫ জন সদস্য নিয়ে একটি সংবিধান সংশোধনী কমিটি গঠন করা হয়। তারা ২৭টি বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ২০১১ সালের ২৯ মার্চ বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অপরিবর্তিত রাখার সুপারিশ করা হয়। সংবিধান সংশোধনী কমিটির সদস্য (সেসময় এঁরা মন্ত্রী ছিলেন) তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, “এটা সেটল ইস্যু, এটা পরিবর্তন করার দরকার নেই।” আমির হোসেন আমু বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে আছে সেভাবেই রাখা উচিত।” রাশেদ খান মেনন বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক পরিবর্তনের দরকার নেই।” ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “সংবিধানে তিন মাস নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে।” শিরীন শারমিন (বর্তমান স্পিকার) বলেছিলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সংশোধনের দরকার নেই।” সাবেক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন, “এমন কিছু করা ঠিক হবে না যা বিতর্ক সৃষ্টি করে।” কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার দরকার নেই।”
বিশ্লেষকগণ মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তেমন কোনো জটিলতা থাকার কথা নয়। এক্ষেত্রে যেমন পূর্বেই সর্বক্ষেত্রেই বিপুল ঐকমত্য তৈরি হয়ে আছে, তেমনই এবিষয়ে সংসদীয় অভিজ্ঞতা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনায় প্রশাসনিক দক্ষতাও যথেষ্ট রয়েছে।