সংখ্যায় বা পরিমাণে কমে গেলেও এখনো এর-ওর কাছ থেকে ঈদের উপহার পাই। চলতি বছর ২০২৩ সালের এপ্রিলে অর্থাৎ এবারের ঈদুল ফিতরেও কিছু উপহার পেয়েছিলাম। বলাবাহুল্য, সেগুলোর সবই ছিল ভারতের পণ্য। ঈদের আগেরদিন রাস্তা ‘ফাঁকা‘ পেয়ে একজন এসেছিলেন ‘সুদূর’ উত্তরা এলাকা থেকে। ‘সুদূর’ শব্দটা আমার সে নিকটজনই ব্যবহার করেছেন। বলেছিলেন, উত্তরা থেকে ঢাকার যে কোনো এলাকার মার্কেট বা শপিং মলে যাতায়াত করার অর্থই হলো কয়েক ঘণ্টা সময়ের এবং বিপুল পরিমাণ টাকার অপচয় করা। এজন্যই কলকাতায় যাওয়াটাকে তিনি ও তার স্ত্রী অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। কারণ, উত্তরা থেকে বিমান বন্দর হাঁটার দূরত্বে অবস্থিত। আর কোনোভাবে বিমান বন্দরে পৌঁছানো গেলেই এক ঘণ্টারও কম সময়ে কলকাতায় যাওয়া যায়। বাড়তি ব্যয় শুধু বিমান ভাড়া এবং কলকাতায় থাকা ও খাওয়ার খরচ।
কিন্তু ঢাকার দামের সঙ্গে কলকাতার দামের বিরাট পার্থক্য যোগ-বিয়োগ করলে দেখা যায়, কলকাতায় গিয়ে আসলে লাভই হয় বেশি। আমার ওই নিকটজনের যুক্তি, ভারতীয় ব্র্যান্ডের পণ্যই যদি কিনতে হয় তাহলে আর বেশি দাম দিয়ে ঢাকায় বা দেশের অন্য কোনো স্থানের মার্কেটে গিয়ে কেনা কেন, খোদ ভারতে গিয়ে কেনাটাই ভালো ও লাভজনক! মাঝখান দিয়ে ‘বিদেশ’ ভ্রমণের বাড়তি আনন্দটুকুও পাওয়া যায়। হোক না সেটা কলকাতা, ‘অন্য দেশ’ ভারতেরই বড় একটা নগরী তো সেটা!
অন্য কিছু যুক্তিও দেখিয়েছেন আমার ওই নিকটজন। বলেছেন, ঢাকাসহ বাংলাদেশের সকল মার্কেটও ভারতের পণ্যসামগ্রীতেই ছেয়ে গেছে। শাড়ি ধরনের দু’-চারটি মাত্র পণ্য ছাড়া কোনো মার্কেটে বাংলাদেশি কোনো পণ্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, কলকাতায় ঢাকা ও বাংলাদেশের যে কোনো মার্কেটের তুলনায় দামও অনেক কম। পাশাপাশি রয়েছে বৈচিত্র্য ও তুলনামূলক মান যাচাই করতে পারার মতো বিষয়গুলো।
এসব কারণেই ঢাকায় সময় ও অর্থের অপচয় করার পরিবর্তে তারা কলকাতায় গিয়েছিল। তাছাড়া কলকাতা তথা ভারত থেকে ভারতীয় ব্যান্ডের স্টিকার লাগানো কোনো পণ্য কাউকে উপহার দেয়ার মধ্যেও রয়েছে আনন্দের উপাদান। যাদের দেয়া হচ্ছে, তাদের চেহারাও নাকি আনন্দে ঝলমল করে ওঠে! আমি নিজেও ঢাকায় বসে ভারতীয় পণ্য উপহার পেয়ে খুশিতে ডগমগ করে উঠেছিলাম কি না, সেকথাটুকু অবশ্য ওই নিকটজন বলেনি!
শুরুতে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললেও বাস্তবে এবারের তথা ২০২৩ সালের ঈদে হাজারের অংকে নয়, লাখের অংকে বাংলাদেশিরা ঈদের কেনাকাটা করতে ভারতের বিভিন্নস্থানে, বিশেষ করে বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় গিয়েছিল। ঈদের প্রাক্কালে বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, কলকাতাসহ ভারতের মার্কেট ও শপিং মলগুলোতে ভিড় জমেছিল লাখ লাখ বাংলাদেশি ক্রেতার। কলকাতায় ঈদের বাজার নাকি জমিয়েই তুলেছিল বাংলাদেশি নারী-পুরুষেরা। অনেকের সঙ্গে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরাও ছিল।
গণমাধ্যমের রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশিদের কলকাতা তথা ভারতে যাতায়াতের বিষয়টিকে সহজ ও আকর্ষণীয় করে তোলার দূরপ্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতও নানামুখী ব্যবস্থা তথা পদক্ষেপ নিয়েছিল। ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাই কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছিল, ২৪টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চেকপোস্ট দিয়ে যাতায়াতকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসায় প্রবেশ ও প্রস্থানে নিষেধাজ্ঞা অপসারণ করেছে ভারত। দেশটির ভিসাপ্রাপ্তি সহজতর করার লক্ষ্যে ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বড় শহরে ভিসা সেন্টার খোলা হয়েছিল। রাজধানীতেও কয়েকটি ভিসা সেন্টার খুলেছিল ভারত। এর ফলে ভারতের ভিসা পাওয়া সময়ের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এমন অবস্থার সুযোগও নিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ।
ওদিকে বিশেষ করে কলকাতার মুসলিম প্রধান বিভিন্ন এলাকায় পুরনোগুলোর পাশাপাশি নতুন এবং অস্থায়ী অনেক মার্কেট ও শপিংমল গড়ে তোলা হয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে এবারের ঈদ উপলক্ষে শাড়ি ও প্রসাধনী সামগ্রীসহ বহু ধরনের পণ্যের ওপর বিশেষ মূল্য ছাড়ও দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে নানা কৌশলে প্রচারণা চালিয়েছিল ভারতীয়রা। জানা গেছে, সহজে ভিসাপ্রাপ্তির পাশাপাশি এই প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়ে এবারের রমযান মাসের শুরুতেই দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি ভারতের ভিসা নিয়েছিল। এর বাইরে মে পর্যন্ত চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভিসা গ্রহণকারীদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে নিয়েছিল। অর্থাৎ ঈদের কেনাকাটার জন্য তো বটেই, এমনিতেও বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ও শহরে যাচ্ছে বাংলাদেশিরা। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের ঈদুল ফিতর এই সময়ের একটি বড় উপলক্ষে পরিণত হয়েছিল।
দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদরা কিন্তু ঈদের কেনাকাটা করতে যাওয়ার বিষয়টিকে অত্যন্ত আশংকাজনক মনে করেন। কারণ, এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি। ঈদের কেনাকাটার জন্য লাখ লাখ বাংলাদেশির কলকাতাসহ ভারতের অন্যান্য স্থানে যাওয়ার অর্থই হলো, এই বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশি বাংলাদেশের পণ্য কিনবে না। তারা কিনবে, বাস্তবে কিনেছেও, ভারতীয় পণ্য। টাকার পরিমাণও চমকে ওঠার মতো। হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য কিনেছে বাংলাদেশিরা। সে কারণে একদিকে বাংলাদেশি পণ্যের বিক্রি ওই পরিমাণে কমেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে বৈধ ও অবৈধ উভয় পথেই ভারতে চলে গেছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
উদ্বেগ ও আপত্তির কারণ হলো, এমন অবস্থা চলছে বহু বছর ধরেÑ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার পর থেকেই। ভারতীয় পণ্যে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশের সমগ্র পণ্যের বাজার। কিন্তু কোনো সরকারের আমলেই ভারতীয় পণ্যের এই আগ্রাসন ও একচেটিয়া রাজত্বের বিরুদ্ধে সুফলপ্রসূ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কথাটা শুধু ভারতীয় পণ্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে না। ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি কুনমিঙসহ চীনের বিভিন্ন শহরেও ঈদের কেনাকাটা করতে যায় বাংলাদেশিরা। এবারও গিয়েছিল অনেক বাংলাদেশি। তাছাড়া, বাংলাদেশের খুব কম মার্কেটেই আজকাল এদেশের পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়। ভারতীয় তো বটেই, বিশেষ করে চীনা পণ্যেও ছেয়ে গেছে দেশের বাজার। আছে অন্য অনেক দেশেরও বাহারী অনেক পণ্য। অথচ বিশ্বব্যাপি অর্থনীতির স্বীকৃত সাধারণ নিয়ম হলো, জাতীয় পুঁজির বিকাশকে বাধামুক্ত করার উদ্দেশ্যে সব দেশকেই তাদের শিল্প-কারখানার জন্য নিরাপত্তা তথা প্রটেকশনের ব্যবস্থা নিতে হয়।
বাস্তবে ভারতসহ সব দেশ অমন ব্যবস্থা নিয়েও থাকে, যাতে ওই দেশের পণ্য অন্য কোনো দেশের পণ্যের কারণে কম বিক্রি না হয়। সেদেশের পণ্য যাতে মার না খায় এবং প্রতিযোগিতায় হেরে না যায়।
এক্ষেত্রেই বাংলাদেশে চলছে সম্পূর্ণ বিপরীত এক ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড। চীন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পণ্য বাজার দখল করে নেয়ায় দেশি পণ্যের বিক্রি তো প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছেই, উৎপাদনের কারখানাগুলোও একের পর এক বন্ধ ও ধ্বংস হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। একই কারণে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যখন লাখ লাখ বাংলাদেশি এমনকি ঈদের কেনাকাটা করতেও ভারতে এবং আশপাশের অন্য দেশগুলোতে ছুটে যাচ্ছে।
দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, জাতীয় পুঁজিসহ দেশের অর্থনীতির জন্য ধ্বংসাত্মক এমন অবস্থার অবসান ঘটানো দরকার। সরকারের উচিত সকল পন্থায় বিদেশি পণ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এজন্য জাতীয় পুঁজির বিকাশকে বাধামুক্ত করার এবং দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ানোর লক্ষ্যে সুচিন্তিত ব্যবস্থা নিতে হবে। জাতীয় পুঁজি ও শিল্পকে সর্বাত্মকভাবে নিরাপত্তা বা প্রটেকশন দিতে হবে। তেমন ব্যবস্থা নেয়া গেলেই ঈদের কেনাকাটার জন্য বাংলাদেশিদের বিদেশে যাওয়া কমানো এবং পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা সম্ভব। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সে লক্ষ্যেই অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
প্রসঙ্গক্রমে ঘাটতির দিকটি প্রাধান্যে এসেছে। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীসহ তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিপুল এই ঘাটতির পেছনে প্রধান ভূমিকা রয়েছে চীন ও ভারতের। দেশ দুটির দিক থেকে নানা ধরনের শুল্ক ও অশুল্কগত বাধার কারণেই বাংলাদেশ রফতানি বাড়াতে পারছে না। প্রকাশ্যে আমদানি বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও দেশ দুটি সুকৌশলে এমন কিছু শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্কগত বাধার সৃষ্টি করে চলেছে, যার ফলে রফতানির সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে বহু পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাও কোটা ধরনের প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে বাংলাদেশের রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা তাগিদ দিয়ে বলেছেন, অর্থ পাচার বন্ধের সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ও প্রবাহ বাড়ানো দরকার, যাতে শিল্পায়নের পাশাপাশি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানি বাড়ানো যায়। শুধু রফতানি আয় বাড়ালেও চলবে না, রেমিট্যান্স এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তথা এফডিআই বাড়ানোর জন্যও সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এফডিআই বাড়ানোর জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী জমি বরাদ্দের পাশাপাশি স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগসহ সকল সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।
এভাবে সব মিলিয়ে ইতিবাচক ব্যবস্থা নেয়া হলেই দেশকে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতির কবল থেকে মুক্ত করা এবং সমৃদ্ধির সুষ্ঠু পথে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। তখন আর ঈদের কেনাকাটার জন্য মানুষকে অন্য কোনো দেশে যেতে হবে না। এ ব্যাপারে সরকারের উচিত ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা এবং অর্থনীতিবিদসহ দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া।