অর্থনীতিবিদদের বিরোধীতা সত্ত্বেও বিশেষ সুবিধা আর ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ কমাতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু সরকারের সব হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়ে উল্টো ব্যাংক খাতের ‘প্রধান সমস্যা’ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, গত তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। ফলে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণকে দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ খেলাপি নামে সমস্যা দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োগের কথাও বলছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের (২০২২) একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না বিশিষ্টজনেরা। খেলাপি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে খেলাপি আদায়ে অ্যাকশনে যেতে হবে বলে মত তাদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত ২০২২ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর সবশেষ ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা।
চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫৭ হাজার ৯৫৮ টাকা। বেসরকারি ব্যাংক ১১ লাখ ৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংক ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বিতরণ করেছে এর মধ্যে খেলাপি ৪ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। বিদেশী ব্যাংক ৬২ হাজার ২৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে তাদের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত মতে, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি হিসেবে দেখাতে হবে। আএমএফ’র হিসাবে খেলাপি দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা।
খেলাপি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণকে দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োগ করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের আরও ভূমিকা পালন করতে হবে।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, খেলাপি ঋণ কমাতে আমাদের তেমন সফলতা আসছে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আর কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে অ্যাকশনে যেতে হবে। একটা সময় দিতে হবে, যে সময়ের মধ্যে খেলাপি কমাতে হবে। আর খেলাপি কমাতে না পারলে সেসব ব্যাংকগুলোর শাখা বন্ধের নির্দেশ দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কঠোর হচ্ছে না, শুধু নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের ২-৩ শতাংশ করে ছাড় দিলে খেলাপি কীভাবে কম, প্রশ্ন রাখেন তিনি। আমাদের এখন খেলাপি কমাতে অ্যাকশনে যেতে হবে। তবে ক্লাইন্টের দুর্বলতাগেুলোও দেখতে হবে। কয়েকজনের সমস্যাতো থাকতেই পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে ছাড় কেনো।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিয়েছিল, তা নিরীক্ষিত ছিল না। তাই পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ খেলাপি করে দেওয়া হয়। আবার কিছু ব্যাংকের ঋণ খেলাপি করার উপযুক্ত হলেও তা নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে তাই মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো এখন নিজেই নিজেদের ঋণ পুনঃতফসিল করছে। ফলে ব্যাংক চাইলেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। তাই খেলাপি ঋণের এ তথ্য প্রকৃত চিত্র নয়। বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরও বেশি হতে পারে। অনেক ব্যাংক ঋণ আদায় করতে না পেরে তারল্য-সংকটে ভুগছে।
এদিকে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো খেলাপির হিসাবে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা কম দেখিয়েছে ৩৩টি ব্যাংক। তবে ৯টি ব্যাংক তাদের সঠিক হিসাব পাঠিয়েছে বলে পরিদর্শনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণ দেখানো হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। হার ছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এর মানে শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমে ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলো গত বছর শেষে খেলাপি ঋণের যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছিল পরিদর্শনের পর তার চেয়ে বাড়তি খেলাপি ঋণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। পরে ওইসব তথ্য ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকের ডিসেম্বরভিত্তিক বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান কার্যালয় ও কয়েকটি শাখা পরিদর্শন করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসা তথ্য, ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তথ্য এবং বহির্নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়। এতে বার্ষিক প্রতিবেদনে ৩৩টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ব্যাংক খাতের ৪২টি ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাত্র ৯টি ব্যাংক খেলাপির সঠিক তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছে। অর্থাৎ এসব ব্যাংক গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যেই তথ্য পাঠিয়েছে পরিদর্শনে এর গরমিল পাওয়া যায়নি। এই ব্যাংকগুলো হচ্ছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী, প্রাইম, সিটি, ব্র্যাক, মধুমতি, মিডল্যান্ড, কমিউনিটি ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
আর বাকি ৩৩টি ব্যাংকের তথ্যেই গরমিল পাওয়া গেছে। এই তালিকায় থাকার রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ৪ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ২৮ ব্যাংকের সব মিলিয়ে খেলাপি বেড়েছে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই ৩৩ ব্যাংক খেলাপির তথ্য গোপন করেছে ১৮ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ফজলে কবির বিভিন্ন ব্যাংকের পরিদর্শনের ওপর শিথিলতা আনেন। এতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংককে বিভ্রান্ত করতে ভুল তথ্য উপস্থাপন করতে শুরু করে। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আবদুর রউফ তালুকদার ব্যাংকগুলোতে পুনরায় পরিদর্শনের নির্দেশ দেন। এতে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন অনিয়ম বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে। বিশেষ করে, ব্যাংকগুলোর ঋণ অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসতে শুরু করলে ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে কঠোর অবস্থানে যান এই গভর্নর। ঋণ অনিয়মে এমডিদের ওপর মালিক পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ করলে তা সরাসরি গভর্নরকে অবহিত করা, কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা, অনিয়মের মাধ্যমে অনুমোদিত ঋণ বিতরণ বন্ধ করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, খেলাপির তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গোপন করা একটি বড় অপরাধ। বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার ব্যাংকগুলোকে সুবিধা ও ছাড় দেওয়ার কারণে এই ধরনের সাহস তৈরি হচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরের ভালোর জন্য এখনই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থানে যাওয়া উচিত।