নানামুখী সংকটের কারণে সরকারের ত্রিমুখী দায় বাড়ছে। প্রথমত রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় দেশের ভেতর থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পৌনে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। দ্বিতীয়-বৈশ্বিক সংকটের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি ভর্তুকি ও প্রণোদনা গুনতে হচ্ছে। সর্বশেষ দায় বাড়ছে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ৭১০ কোটি টাকা। দায়ের এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে। যা ১ জুন অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সংকট ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে চলতি বাজেট বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকায় দেশের ভেতর এর প্রতিঘাত পড়েছে। ফলে অর্থবছরের শুরুতে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়, বছর শেষে তা কমিয়ে ছয় লাখ ৬০ হাজার ৫০৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ব্যয়সীমা মাত্র ১৭ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা কমানো হয়। ফলে বাকি ব্যয় করতে গিয়ে সরকারকে বড় অঙ্কের ঋণ করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, সরকার অভ্যন্তীরণ পর্যায়ে ঋণ বেশি করলে এর নেতিবাচক প্রভাব বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর পড়বে। কারণ বেসরকারি খাতে ঋণ কম যাবে। আর বেসরকারি খাতে ঋণ কম হলে বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আহরণ অর্জন করতে না পারলে ব্যয় মেটাতে সরকারকে ঋণ করতে হয়। বর্তমান কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। এছাড়া ঋণের ভিন্ন একটি উৎস বৈদেশিক ঋণ। কিন্তু সেখান থেকে ঋণ গ্রহণের সীমাবদ্ধতা আছে। সময়সাপেক্ষ অন্যদিকে নানা শর্তের কারণে সম্ভব হয় না। আগে সঞ্চয়পত্র ঋণের একটি বড় উৎস ছিল। সেখান থেকেও কম নেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকার যে বড় অঙ্কের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তার একটি বড় অংশ আসতে হবে ব্যাংক থেকে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অবস্থাও ভালো নয়।
সূত্রমতে, সংশোধিত চলতি বাজেটে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। শুরুতে ছিল এক লাখ ৬৫ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এই ঋণের বড় অংশ অর্থাৎ এক লাখ ৯৫ হাজার ২৫ কোটি টাকা নেওয়া হচ্ছে ট্রেজারি বিল থেকে। বছরের শুরুতে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবল (আইএমএফ) শর্ত হচ্ছে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার অঙ্ক পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা। ব্যাংক থেকেও কম নেওয়ার কারণে ট্রেজারি বিল থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার।
সূত্র জানায়, এ বছর রাজস্ব আদায় কম হওয়া সরকারের ঋণ গ্রহণ বাড়ছে। আর আয় কমার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ডলার সংকট মোকাবিলায় বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা। ফলে আমদানি খাত থেকে রাজস্ব কমছে। এছাড়া অস্বাভাবিক হারে ভোজ্যতেল ও চিনির মূল্য বৃদ্ধির কারণে এ দুটি পণ্য উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ও ভ্যাট কমানো হয়। যে কারণে এসব খাত থেকে রাজস্ব কমছে। পাশাপাশি জিনিসপত্রের অস্বাভাকি মূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ছোট ছোট ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর।
ঋণ বৃদ্ধির কারণে সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয়ও বাড়ছে। এরমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয় ৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিল সুদ ৭০০ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ ২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত গুনতে হবে। এই তিন খাতে মোট সুদ ব্যয় হবে ৮১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
এদিকে বৈশ্বিক সংকটে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। চলতি বাজেট প্রণয়নের সময় (২০২২ সালে মে’ হিসাব) পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ডলারের মূল্য ধরা হয় ৮৭ টাকা। কিন্তু সেখান থেকে বেড়ে বর্তমান ডলারের মূল্য এখন ১০৭ টাকা। প্রতি ডলারের মূল্য ২৭ টাকা বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে সরকারের বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে ৭১০ কোটি টাকা।
বৈশ্বিক সংকটে আরও একটি খাতে সরকারের দায় বেড়েছে। সেটি হচ্ছে ভর্তুকি ও প্রণোদনায়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি কারণে বিদ্যুৎ খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ছয় হাজার কোটি টাকাসহ মোট ভর্তুকি ব্যয় বেশি গুনতে হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতে এ খাতে ৪৯ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলে শেষ পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে ৫৯ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা।