অর্থবছরের ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) বাস্তবায়নে বিরাজ করছে করুণ চিত্র। শতভাগ অগ্রগতি অর্জন করতে হলে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সামনে রয়েছে মাত্র দুই মাসে ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ের চ্যালেঞ্জ। কেননা জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। কিন্তু মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এ হিসাবে বাকি টাকা ব্যয় করতে হলে মে ও জুনে প্রতিদিন ব্যয় করতে হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা করে। যেখানে গত ১০ মাসে প্রতিদিন গড়ে ব্যয় হয়েছে ৩৯৭ কোটি টাকা করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখাতে গিয়ে অর্থ অপচয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবছর একই চিত্র বিরাজ করলেও সমাধান নেই। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সরকারিভাবে ব্যাখ্যা হচ্ছে-শেষ সময়ে প্রচুর বকেয়া বিল পরিশোদ করা হয়। অর্থাৎ কাজটা আগে হয় আর বিল দেওয়া হয় পরে। সেটি হলে অপচয় হয়তো হবে না। কিন্তু ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং সিটি করপোরেশনগুলো যেভাবে শেষ সময়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দেয়, এতে কাজের চেয়ে বরাদ্দ টাকা যাতে ফেরত না যায়, সেটিই মুখ্য বিষয় থাকে। কেননা, একবার টাকা ফেরত গেলে পরের বছর বরাদ্দ পেতে সমস্যা হবে। ফলে কোনোরকমে কাজ শুরু করে বিলটা উঠিয়ে নেওয়াই উদ্দেশ্য থাকে। এতে অপচয়ের বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়। শেষ সময়ে বিল পরিশোধ কিংবা তাড়াহুড়ো করে অর্থব্যয়-কোনোটিই কাম্য নয়। বিশ্বব্যাংক সব সময়ই এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে আরএডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৫০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৫৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এদিকে গত ১০ মাসেও নয়টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার আরএডিপির বাস্তবায়ন হার ৩০ শতাংশের নিচে। পাশাপাশি ৫০ শতাংশের নিচে রয়েছে ২৯টির বাস্তবায়ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরকারের যে কৃচ্ছ সাধন নীতি, এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আরএডিপিতে। সেই সঙ্গে তীব্র ডলার সংকট এজন্য দায়ী।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার প্রকৃত কারণ যদি আমি জানতাম, তাহলে তো নিজেকে অনেক জ্ঞানী মনে হতো। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দায়িত্ব যখন ভাগাভাগি হয়, তখন সবার ওপরই সমান কাজের দায় আসে। কিন্তু দেখা যায়, সবাই সমানভাবে কাজটা করতে পারে না। এছাড়া প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলেও এক্ষেত্রে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তারা অপক্ষাকৃত নিচের দিকের। অর্থাৎ পিডি নিয়োগ অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হয় না। পিডিরা জুনিয়র অফিসার হওয়ায় তারা সব সময় ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সেই সঙ্গে অর্থ বরাদ্দের পর ছাড়ের প্রক্রিয়া এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও সেটি কাজ করছে না। এক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিকতা আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে শেষ সময়ে কাজ হলেও অনেক প্রকল্পে বিল দেওয়া বাকি থাকে। যখনই এই বিল পরিশোধ করা হবে, তখনই অনেক বেশি বাস্তবায়ন হার দাঁড়াবে।
আইএমইডির বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোনো অর্থবছরই এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণ হয় না। মূল এডিপিতে যা বরাদ্দ ধরা হয়, অর্থবছরের মাঝপথে এসে কাটছাঁট করে কমিয়ে তৈরি করা হয় সংশোধিত এডিপি। আবার অর্থবছর শেষে সেটিরও কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়নের দেখা মেলে না। গত অর্থবছরের মোট এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) আকার ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। পরে ১৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলে সংশোধিত এডিপির আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। পুরো অর্থবছর (জুলাই-জুন) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে ২ লাখ ৩ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। ফলে ব্যয় করা যায়নি ১৫ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের আরএডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খরচ হয় ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। অব্যয়িত থেকে যায় ৩৭ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরএডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। অব্যয়িত থেকে যায় ৩৯ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরএডিপির ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকা থেকে ব্যয় হয় ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। অব্যয়িত থাকে ৯ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরএডিপি ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা, ব্যয় হয় ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। অব্যয়িত থাকে ৯ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছর আরএডিপি বাস্তবায়নের করুণ চিত্র প্রসঙ্গে কথা হয় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কমে যায় টাকার মান। এ অবস্থায় আমাদের দেশে ইট, পাথর, সিমেন্ট, বিটুমিনসহ সব নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। আমাদের এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই ভৌত অবকাঠামোসংক্রান্ত। ঠিকাদাররা তাই কাজ বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্রসহ প্রয়েজনীয় সব জিনিসের দামই বাড়ে। এ অবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে দাম নির্ধারণ করা হয়। এতে বেশ খানিকটা সময় চলে যায়। ফলে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যায়।
এডিপি বাস্তবায়নে ৩০ শতাংশের নিচে রয়েছে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। আরও আছে ভূমি মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।