আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ করতে জো বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এ নীতিতে বলা হয়েছে, প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা, আইন শৃংখলা বাহিনী, বিচারক, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী যারাই নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধার সৃষ্টি করবে তাদের জন্য নতুন ভিসা নীতি কার্যকর হবে। মার্কিন এই ভিসা নীতি ঘোষণা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। সর্বোত্রই এ নিয়ে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক চলছে। তবে নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেন সেই সেই সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে এ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ভিসা নীতি এখন টক অব দ্য সচিবালয় হয়ে গেছে। কারণ স্যাংশন দেয়া হয় ব্যাক্তির ওপর। আর ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে সবার ওপর। মার্কিন প্রশাসনের চোখে যারাই অভিযুক্ত হবেন তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে আসবে।
সচিবালয়ে গত দু’তিন দিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক বড় বড় কর্মকর্তারা মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির নড়ে বসেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নি¤œপর্যস্ত কর্মচারীদের মধ্যে আলোচনা ও সমালোচনা, ভীতি, গুনঞ্জন চলছে। ইতোমধ্যে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা নিরেপক্ষ হওয়ার চেস্টা চালাচ্ছেন। যারা এতোদিন আওয়ামী লীগার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাদের অনেকেই আতস্কের মধ্যে রয়েছেন। এর আগে র্যাবের ৭ সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লংঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশাসনে তোলপাড়। তবে এ বিষয়ে কোনো প্রশাসনের কর্মকর্তা মুখ খুলতে চান না। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ‘বিদেশে যারা টাকা পাচার করেন এবং কানাডার বেগম পাড়ায় বাড়ি এমন ব্যাক্তিদের মধ্যে রাজনীতিকের সংখ্যা কম বেশির ভাগই আমলা।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে যারা সচিব পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে যাদের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা রয়েছে। হয় তাদের সন্তানরা সেখানে লেখাপড়া করেন অথবা তাদের সেখানে ঠিকানা রয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি করে আয় রোজগার করে স্ত্রী-সন্তানের নিরাপদ জীবনের কথা ভেবে সে দেশে পাচার করেছেন। এরকম বাস্তবতার প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রশাসনে কর্মরত প্রভাবশালী আমলাদের একটি বড় অংশের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি রয়েছে। অন্তত ৩২ জন আমলার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং যুক্তরাজ্যে বাড়ি করেছেন এমন গুঞ্জন রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রিন কার্ডও নিয়েছেন এমন কথাও শোনা যায়। বাংলাদেশে যারা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আছেন এদের বেশিরভাগেরই সন্তান-সন্ততিরা বিদেশে পড়াশোনা করেন। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ও যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করছেন। যাদের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে নেই বা যাদের ঘরবাড়ি যুক্তরাজ্য বা কানাডায় তারাও কিছুটা আতঙ্কে আছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতির ফলে যুক্তরাজ্য ও কানাডা সরকার প্রভাবিত হতে পারে বলে তারা শঙ্কা প্রকাশ করছে। এর ফলে আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের নিরপেক্ষ অবস্থান তৈরি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল রোববার সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, অর্থ বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ভুমি মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বানিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘুরে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নি¤œ পর্যায় পর্যন্ত কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সবার মধ্যে একই আলোচনা। তারা সবাই বলছেন আগামীতে কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যাদের টাকা যুক্তরাষ্ট্র আছে তারা কি করবো।
বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমলার যুক্তরাষ্ট্র কানাডা এবং যুক্তরাজ্যে যেমন বাড়িঘর রয়েছে এমন খবর প্রচারের পর কিছুদিন আগে কানাডায় কাদের বাড়িঘর আছে এরকম একটি বিষয় নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করেছিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে যে, কানাডায় বেগম পাড়ায় বাড়ি রয়েছে এমন ব্যাক্তিদের মধ্যে আমলাদের সংখ্যা বেশি। কাজেই নতুন ভিসানীতি আমলাদের ওপর বেশি পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে আগামী নির্বাচনে প্রশাসনের ভুমিকায় একটি নাটকীয় পরিবর্তন আসমে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছক এক অতিরিক্ত সচিব ইনকিলাবকে বলেন, আসলে এ বিষয়টি দেশের জন্য ক্ষতি করবে। তবে যেসব কর্মকর্তা ও তার পরিবারে ছেলে মেয়েরা লেখা পড়া করছেন এবং ব্যবসা করছেন তারা বেশি বিপদে করবেন। যেসব সচিবসহ প্রশাসনের বড় বড় অফিসারদের যুক্তরাষ্ট্রে ছেলে ও মেয়ে লেখাপড়ার জন্য রয়েছে এবং তাদের বাড়ি ঘর রয়েছে তারা এখন আতঙ্কের রয়েছেন। যে সব কর্মকর্তারা দলবাজি করে গত কয়েক বছর থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন তাদের টাকা নিয়ে আসতে পারবে না। সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের এক কর্মকর্তা বলেন, মার্কিন ভিসা নীতিতে বেশি ক্ষতি হবে সরকারি কর্মকর্তাদের। কারণ তাদের অনেকের স্ত্রী-সন্তান ও ব্যবসা রয়েছে।
সচিবালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রশাসনে রদবদল রুটিন কাজ হলেও এ বছরের শেষে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন, তাই প্রশাসনের শীর্ষ পদে কারা থাকছেন, তা নিয়ে এবার আলোচনা কিছুটা বেশি। সরকারের মধ্যেও চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি ও নিযুক্তি দিয়ে চলেছে সরকার। বিপরীতভাবে সরকার সমর্থক না হওয়ার কারণে অনেককে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে, এখনো চাকরি হারাচ্ছেন অনেকে। তাদের সংখ্যা দু’ হাজারের ওপরে পৌঁছে গেছে। লজ্জা, দুঃখ ও অপমানে অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকুক না থাকুক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক অফিসাররা পদোন্নতি ও আকর্ষণীয় বিভিন্ন পদে নিযুক্তি পেয়েছেন, এখনো পাচ্ছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতর ও বিভাগের শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে তাদের। জনপ্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বেছে বেছে লোকজনকেই বসানো হয়েছে। এর ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থক অফিসারদের মধ্যেও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে।
গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিবদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানায়, কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রশাসনিক প্রধানরা বিদেশ যাওয়ার নিয়ম মানছেন না। ‘সিনিয়র সচিব/সচিবগণের ভ্রমণসূচি প্রেরণ’ বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সরকারের সিনিয়র সচিব/সচিবদের ব্যক্তিগত কিংবা দাপ্তরিক কাজে দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে ভ্রমণসূচি যথাসময়ে এ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে না। এতে রাষ্ট্রাচারসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় সব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ও কর্মসূচিতে সরকারের সিনিয়র সচিব/সচিবদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেহেতু দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে তার ভ্রমণসূচি এ বিভাগে পাঠানো নিশ্চিত করা আবশ্যক।’ এই চিঠিতে পরিস্কার প্রশাসনে কর্মরত আমলাদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কত প্রখর।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান ইনকিলাবকে বলেন, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেটি এখনো কারো ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটি বলা হয়নি। কারণ দেখানো হয়েছে বাংলাদেশে গনতন্ত্র, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা দিয়েছে। যারা গনতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করবে এবং দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যারা অন্যায় কাজ করবেন এবং যারা দুর্নীতি করে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি ঘর করেছেন তারা তো আতস্কে থাকবেন। যার যারা দুর্নীতি করে নাই তারা পড়বে না। যুক্তরাষ্ট্র কোনো কিছু করার আগে দীর্ঘ ৫ থেকে ৭ বছর বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে। দফায় দফায় সরকারের সাথে বৈঠকেও করেছে। যখন তারা দেখছে বাংলাদেশে গনতন্ত্র, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত নয় তখন তা মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।