ঘটনা মাস সাতেক আগের। রাজধানীর খামারবাড়ির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সমকালে প্রকাশ হয় একটি প্রতিবেদন। ওই সংবাদ ঘিরে শুরু হয় তোলপাড়। কর্মকর্তাদের কানে আসে, অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমকর্মীর কাছে সরবরাহ করেন চার কর্মচারী। তাতেই একরোখা হয়ে ওঠে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। সমকালকে তথ্য দেওয়ার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে গঠন হয় তদন্ত কমিটি। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁদের ই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তদন্ত কমিটি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
পরে শাস্তির খড়্গ নামে তাঁদের ওপর। চার কর্মচারীকে বদলির চিঠি হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাঠানো হয় রাজধানী থেকে দূর-দূরান্তে। তবে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতরা থেকে যান আড়ালে। বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও প্রতিকার না পেয়ে আদালতের আশ্রয় নেন কর্মচারীরা। আদালত বদলির বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেন। এতে আরও তেতে ওঠে ডিএই কর্তৃপক্ষ। বন্ধ করে দেওয়া হয় চার কর্মচারীর বেতন-ভাতা। এ পরিস্থতিতে অমানবিক জীবন পার করছেন এসব কর্মচারী। তাঁদের দাবি, কোনো অপরাধ না করেও শাস্তির মুখে পড়েছেন তাঁরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে মরিয়া হয়ে উঠেছে খামারবাড়ি কর্তৃপক্ষ। সাংবাদিকদের তথ্য না দিতে দেওয়া হয়েছে সতর্কবার্তা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন ঘটনা গণমাধ্যমের জন্য হুমকি। আর কর্মচারীদের ই-মেইল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ব্যক্তির অধিকার হরণের শামিল।
অনিয়ম করেও হয়নি শাস্তি
গত ১১ অক্টোবর ‘খামারবাড়ি যেন দুর্নীতির বাড়ি’ ও ‘নালিশে শান্তিতে অনড় নাসির’ শিরোনামে দুটি সংবাদ প্রকাশ হয় সমকালে। এতে উঠে আসে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে এক কর্মচারীর ধনকুবের হয়ে ওঠার কাহিনি। পাশাপাশি নিয়োগ-পদোন্নতিতে দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা, জেলা-উপজেলায় বরাদ্দে কমিশন আদায়, কর্মকর্তাদের মধ্যে দলাদলি, সেবা দিতে টাকা লেনদেনসহ নানা অনিয়মের তথ্য প্রকাশ হয়। এতে প্রায় দুই ডজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম উঠে আসে। সংবাদ প্রকাশের পরপরই প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের প্রধান সহকারী আব্দুল হান্নান খান ও একই শাখার উচ্চমান সহকারী মো. নাসির উদ্দিনকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হলেও বাকিদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। উল্টো প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের মোহাম্মদ বনি আমিনকে প্রকল্প পরিচালক করা হয়েছে। কয়েকটি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলেও অভিযুক্তরা থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এ সুযোগে প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের উপপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড সাপোর্ট সার্ভিসেস) মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, উপপরিচালক (পার্সোনেল) মো. আব্দুল হাই, প্রধান সহকারী মো. তৈফুর রহামান, অর্থ হিসাব ও নিরীক্ষা শাখার ঊর্ধ্বতন হিসাবরক্ষক এস এম এস আজম সরকারসহ একটি চক্র অনিয়ম-দুর্নীতি ছাইচাপা দিতে নড়েচড়ে বসেন।
গত ১৬ এপ্রিল অনিয়ম-দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তাইজুল ইসলামকে ডিএইর অর্থ উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক থেকে সরিয়ে বাজেট অফিসার পদে বদলির আদেশ জারির পর তাঁর অনুসারীরা মহাপরিচালকের (ডিজি) কক্ষে তালা, বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ ও হামলা চালায়। এতে দুই কর্মচারী মো. সাজ্জদ নূর ও মেহেদী হাসানকে আহতের ঘটনায় মামলা হলেও নেওয়া হয়নি বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা। যদিও ডিএইর ডিজি বাদল চন্দ্র বিশ্বাস তখন বলেছিলেন, হামলাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি উল্টো হামলায় আহতদের দোষী প্রমাণের তৎপরতা শুরু করে।
শাস্তি পেলেন চার কর্মচারী
সমকালে গত ১২ অক্টোবর প্রতিবেদন প্রকাশের পর ডিএইর ডিজি মো. বেনজীর আলমের (বর্তমানে অবসরে) সইয়ে একটি চিঠি জারি হয়। গোপন তথ্য পাচারের বিষয়ে ওই চিঠিতে বলা হয়, “গত ১১ অক্টোবর দৈনিক সমকালে ‘খামারবাড়ি যেন দুর্নীতির বাড়ি’ শিরোনামে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ হয়। মহাপরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য এবং অফিসের ই-নথিসহ অনেক গোপনীয় তথ্য বে-আইনিভাবে পাচার করার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো।” চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘সংযুক্ত রেকর্ডপত্রের আলোকে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ই-মেইল, মেসেঞ্জার, ফেসবুক ও অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট জব্দ করে তথ্য যাচাই করতে হবে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অপকর্মের সঙ্গে জড়িত অন্য ব্যক্তিদেরও শনাক্ত করতে হবে। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।’
ওই দিনই প্রধান সহকারী মো. শাহাদৎ হোসেনকে পঞ্চগড়ে, উচ্চামন সহকারী মো. বেলাল হোসেনকে খুলনায়, উচ্চমান সহকারী মো. সাজ্জাদ নূরকে সিলেট ও উচ্চমান সহকারী মো. মনির হোসেনকে বরিশালে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়। বদলি ঠেকাতে গত ১৬ অক্টোবর চার কর্মচারী ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলা করেন। পরে আদালত তাঁদের বদলির বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেন। এর পর কোনো লিখিত নির্দেশনা ছাড়াই কর্তৃপক্ষ ওই কর্মচারীদের বেতন বন্ধ করে দেয়।
বেতন না পেয়ে ঢাকায় পরিবার নিয়ে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন চার কর্মচারী। উপায় না দেখে তাঁরা বর্তমান মহাপরিচালক বদল চন্দ্র বিশ্বাসসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন করেও প্রতিকার পাননি। এ ব্যাপারে জানতে ভুক্তিভোগী কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমকাল। প্রথমে ভীত-সন্ত্রস্ত কর্মচারীরা অপরাগতা প্রকাশ করলেও পরে কথা বলেন।
সম্প্রতি খামারবাড়িতে হামলার শিকার কর্মচারী মো. সাজ্জদ নূর সমকালকে বলেন, ‘সমকালে দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর খামারবাড়ির সিন্ডিকেট আমাকে টার্গেট করে। তদন্ত কমিটি আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ পায়নি। তবু আমাকে বদলি করা হয়েছে, বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সিন্ডিকেটের সদস্যরা আমার ওপর হামলাও চালিয়েছে। এ ব্যাপারে মামলা হলেও আসামিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন আমাকে ও পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’
ভুক্তভোগী কর্মচারী মো. বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমার সংসারে আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্ত্রী, তিন সন্তান ও অসুস্থ মাকে নিয়ে ঢাকার বাসায় খুব কষ্টে আছি। দুই ছেলেকে অর্থকষ্টে লেখাপড়া করাতে পারছি না। ইতোমধ্যে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে।’
কর্মচারী মো. শাহাদৎ হোসেন বলেন, ‘আমার স্ত্রী খামারবাড়িতে প্রধান সহকারী পদে চাকরি করেন। ছেলের ব্রেনে ২০২০ সালে জটিল রোগ ধরা পড়ার পর ভারতে চিকিৎসা নিয়েছি। অপারেশন করে আর্টিফিসিয়াল খুলি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ঢাকায় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে সপ্তাহে এক দিন ডাক্তার দেখাতে হয়। এ অবস্থায় বদলি ও বেতন বন্ধের কারণে আমার পরিবারে কষ্টের শেষ নেই। সরকারি চাকরজীবী স্বামী-স্ত্রী একত্রে চাকরি করার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।’
এ ব্যাপারে কথা বলেত ডিএইর সাবেক মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর তিনটি মোবাইল ফোন নম্বরে মেসেজ দেওয়ার পরও কোনো জবাব আসেনি। আর বর্তমান মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস নেদারল্যান্ডসে অবস্থান করায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, এটি প্রশাসনিক ব্যাপার। কর্মচারীদের বদলি কিংবা বেতন বন্ধ কী কারণে– তা আপনাকে বলা যাবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি সহায়ক একটি পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল প্রকাশিত সংবাদে উত্থাপিত সংবাদের তথ্য তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। এটি না করে তথ্য দেওয়ার অভিযোগে কিছু কর্মচারীকে দায়বদ্ধ করা হয়েছে, তাতে দুর্নীতি আরও সুরক্ষিত হলো। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিণত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়টি নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকারি অফিসে সব কাজ হতে হবে আইনসম্মত। এ ঘটনায় যারা ভুক্তভোগী, তাঁরা আদালতে যেতে পারেন।