চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা এলাচের দাম পড়েছে প্রতি কেজি গড়ে ৮১৫ টাকা। কিন্তু পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা কেজিতে প্রায় দ্বিগুণ লাভ করছেন। প্রতি কেজি আদার আমদানি মূল্য ১০১ টাকা। তবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। প্রতি কেজি আদা আমদানি মূল্যের চেয়ে তিন গুণ দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। একইভাবে মুনাফা করছেন জিরা, লবঙ্গ, রসুন, দারচিনি, হলুদ, মরিচ, জয়ত্রিসহ অন্য মসলায়ও।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি কম হওয়ায় পণ্যের দাম বাড়ছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, গতবারের তুলনায় এবার আমদানিও বেশি হয়েছে মসলার।
চলতি বছরের শুরু থেকে ২৫ মে পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টন রসুন আমদানি হয়েছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় তা প্রায় ৯ হাজার টন (৫৬% শতাংশ) বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার আদা বেশি এসেছে ৪০ শতাংশ। একইভাবে লবঙ্গ ৩০, মরিচ ১১ ও রসুনের আমদানি বেশি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। গতবারের তুলনায় গড়ে প্রায় দ্বিগুণ আমদানি হয়েছে মসলা। তবুও আমদানি মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি মসলা।
বন্দর থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ও পাইকারি মোকাম ঘুরে দাম বাড়ার এ চিত্র পাওয়া গেছে। দাম বাড়ার ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
মসলার আমদানিকারক শতাধিক হলেও এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ৪০ থেকে ৫০ জন। আমদানি করা মসলার ৭০ শতাংশই আছে তাঁদের গুদামে। এখন সিন্ডিকেট করে তাঁরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন বাজারে। আবার সামনে ঈদ থাকায় একসঙ্গে অনেক মসলা কিনছেন ভোক্তাদের কেউ কেউ। এতে বেড়েছে চাহিদা। চাহিদা বাড়া ও সরবরাহ কমায় অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে মসলার বাজার। এ দুটি মূল কারণ।
এ ছাড়া শীর্ষ ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতা, সরকারের নজরদারির দুর্বলতা ও খুচরা বাজারে দাম নিয়ে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। ডলারের উচ্চমূল্যও মসলার বাজার অস্থির হওয়ার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগির আহম্মদ বলেন, মসলার বাজারে তিন ধরনের ব্যবসায়ী আছেন। কিছু ব্যবসায়ী ট্যাক্স, ভ্যাট দিয়ে বৈধ পথে আমদানি করেন। কিছু ব্যবসায়ী অবৈধ পথে ভেজাল মসলা এনে কম দামে তা বাজারে বিক্রি করেন। এর বাইরে অন্য ব্যবসায়ীরা সংখ্যায় কম হলেও প্রভাবশালী। বেশিরভাগ আমদানি তাঁরাই করেন। তাঁরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, মসলার পর্যাপ্ত আমদানি আছে। দামও বিশ্ববাজারে মোটামুটি স্থিতিশীল। তার পরও গত ঈদের তুলনায় এবার প্রতিটি মসলার দাম কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তারা। দ্বিগুণ দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
তবে বাংলাদেশ মসলা ব্যবসায়ী সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট অমর কান্তি দাস বলেন, জিরা এবং এলাচ গতবারের তুলনায় কিছুটা কম আমদানি হয়েছে। ভারত, আফগানিস্তান ও ইরানে জিরার ফলন কম হওয়ার প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে। এ দুটি পণ্যের দাম তাই বাড়তির দিকে। কিছু পণ্য বেশি এলেও ডলারের অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে সেগুলোতে।
চট্টগ্রামের পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জে গত কোরবানির ঈদের তুলনায় এবার দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে মসলা। এসব পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিতে ৩০ থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে এখনও আছে মসলাবোঝাই জাহাজ। দেশের স্থলবন্দরগুলো দিয়েও প্রতিদিন আসছে মসলা।
আমদানি বেড়েছে
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে ২৫ মে পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় ৫০০ টন জিরা আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানি ছিল মাত্র ৩০০ টন। এবার একই সময়ে সাড়ে ৫ হাজার টন দারচিনি, ৪২৫ টন লবঙ্গ, ৮৬০ টন এলাচ, ১ হাজার ২৫৩ টন জিরা, ১০৬ টন জয়ত্রি এবং ৪৯৩ টন গোলমরিচ আমদানি হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার ব্যারিস্টার বদরুজ্জামান মুন্সী বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার লবঙ্গ, মরিচ ও রসুনের আমদানি বেশ বেড়েছে। এ বন্দর দিয়ে জিরা এবং এলাচ কিছুটা কম আমদানি হলেও স্থলবন্দর দিয়ে আবার এ দুটি পণ্য বেশি এসেছে।
অস্বাভাবিক মুনাফা
এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি লবঙ্গের দাম বেড়েছে ৮০ টাকা। এখন দাম ১ হাজার ৫০০ টাকা। তবে প্রতি কেজি লবঙ্গের আমদানি মূল্য ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এক সপ্তাহ আগের তুলনায় এলাচের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। এর আমদানি মূল্য গড়ে ৮১৫ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি গোলমরিচ বিক্রি হচ্ছে ৬৬০ টাকা। এক সপ্তাহ আগের তুলনায় কেজিতে ৬০ টাকা বেড়েছে।
পাইকারি বাজারে একইভাবে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে জিরা, দারচিনি ও জয়ত্রি। বর্তমানে দারচিনি ৩২০ টাকা, জিরা ৭৭০ টাকা, জয়ত্রি ৩ হাজার ২০০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। গত সপ্তাহেও এসব মসলার দাম কেজিতে ৩০ থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত কম ছিল। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আদার দাম। এক মাস আগেও মিয়ানমারের প্রতি কেজি আদা ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। এখন দাম দ্বিগুণ, বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।