চার পাশ থেকে যখন অনবরত এমন সব তথ্য খবর মানুষ পেতে থাকে যেগুলো হতাশা, দুশ্চিন্তার, দুর্ভোগের ও উদ্বেগের- তখন আর কারও পক্ষেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। অজানা সব ভীতি আশঙ্কা এসে মানুষের মনমানসকে তিক্ত-বিরক্ত করে, তার চিত্তবৈকল্যে সৃষ্টি করে। সাধারণ তো বটেই যাদের ট্রেস নেয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি, তাদের পক্ষেও কিছু ঘটনা হজম করা খুব কঠিন হয়ে যায়। তখন কারো পক্ষেই আর নিজেকে সামলে রাখা সম্ভব হয় না। একসময় ভেঙে পড়েন। তখন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ বোধশক্তিহীন, স্থবির হয়ে পড়েন। তার পক্ষে কোনো প্রকার দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে কোনোভাবেই উদ্দীপ্ত, তৎপর ও সময়ের প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তিনি কেবলই পিছু হটতে থাকেন। সে ক্ষেত্রে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যেখানে কোনো আশা থাকে না, থাকে না কোনো ভরসা। নিজের ওপর সব বিশ্বাস ও আস্থা নিঃশেষ হয়ে যায়। স্বয়ং রাষ্ট্র তখন একটা অন্ধকার খাদের পাশে এসে উপস্থিত হয়। কখন যে সব কিছুর পতন ঘটবে সেটা তখন কেবল কাল গণনার পর্যায়ে এসে উপনীত হয়।
অনেকেই মনে করতে পারেন এসব কথা একান্ত ও কল্পনাপ্রসূত তাত্ত্বিক বিষয়। অস্বীকার করব না। কেউ কেউ নিজের মনকে প্রবোধ দিতে এমনটা ভাবতেই পারেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, দেশবাসী অতীতের সেই সুখের ঘরের চাবিটা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন। আমরা চেষ্টা করব হতাশা হতোদ্যম হওয়ার যত কারণ তার কিঞ্চিৎ বর্ণনা করার। এখানে কল্পনার আশ্রয় প্রশ্রয় থাকবে না। বিষয়ভিত্তিক কথা বলার চেষ্টাই কেবল হবে। সংবাদপত্রকে সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার একটি বিশ্বস্ত মাধ্যম হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র বিবেচনা করে থাকেন। কেননা সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা কারো অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। সেজন্যে সবার কাছেই তারা আস্থাভাজন। এমন দায়িত্ব তারা অতীতেও পালন করেছেন। এখনো সেখান থেকে এতটুকু হটে যাননি। কেননা তারা দায়বদ্ধ নিজেদের বিবেকের কাছে এবং তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই জনপদের কোটি কোটি মানুষের কাছে, যাদের অধিকাংশই বঞ্চিত নিপীড়িত ও অধিকার হারিয়ে সর্বস্বান্ত যত মানুষ।
এখন সংবাদপত্র থেকে সেই সব খবর চয়ন করে তার মাত্র কয়েকটি দেশের সাধারণ মানুষ, অগ্রসর মানুষ ও বোধ্যার সম্মুখে তুলে ধরতে চেষ্টা করব। আমরা অবশ্যই জানি, অগ্রসর ও বোধ্যাদের এসব খবর কখনো চোখ এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু অগুনতি সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যেতেই পারে এবং তাদের অবহিত থাকতে হবে আমরা এখন কোন বাহনের পিঠে আরোহণ করে আছি, আর তার লক্ষ্য নিশানা ও গন্তব্য কোথায়।
প্রথমত আমরা ইংরেজি দৈনিকের একটি খবর উদ্ধৃত করছি। সেখানে বলা হয়েছে, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে খুব বড় ধরনের ঋণ নেয়া অব্যাহত রেখেছেন, যেহেতু সরকারের কাছে অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের মতো পর্যাপ্ত তহবিল নেই। তাই সরকার এখন আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ মে থেকে সরকার চলতি অর্থবছরের ১০ মে পর্যন্ত ৬৭,৯০৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। কিন্তু অন্যান্য সূত্র বলছে, এই ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি।
একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকের খবর হচ্ছে, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অস্বাভাবিক হারে ঋণ গ্রহণ এখন বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ৩৯ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছরে ১৮৫ শতাংশ বেশি ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেশ এখন কোন অজানা গন্তব্যে ছুটছে। এতে শুধু হতাশা নয়, ভয়ঙ্কর এক পরিণতি এগিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম একটি খাত হলো রেমিট্যান্স। এ ক্ষেত্রে দুই দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব থেকে বেশির ভাগ অর্থ দেশে আসে। কিন্তু ইদানীং দেশ দুটো থেকে রেমিট্যান্স আসার প্রবাহ কমে গেছে। সাম্প্রতিক হিসাব অনুসারে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে কমেছে ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এই প্রবাহ কমার অর্থ হচ্ছে আমাদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়া। অবশ্যই এই তথ্য জাতীয় অর্থনীতির নীতিনির্ধারকদের জন্য হতাশাজনক। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতের সংখ্যা খুব কম, তার ওপর এভাবে প্রধান উৎসগুলো থেকে অর্জন কমতে থাকলে পরিণতি খুবই হতাশার, বিকল্প কোনো উৎস আমরা তৈরি করতে পারিনি।
প্রতিটি সরকারের সক্ষমতার একটি খতিয়ান তার জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নের অবস্থা থেকে পাওয়ায় যায়। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনের তুলনায় এমনিতেই বরাদ্দ থাকে কম। গত বছর যে বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে মিলেছে, তাও খরচ করে শেষ করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি বছর এমন চিত্রই ফিরে ফিরে আসে। দেখা গেছে বিগত অর্থবছরে বরাদ্দের বড় একটি অংশ ফিরিয়ে দেয়া যেন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এই অর্থবছরের (২০২২-২৩) এর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৪ শতাংশ; টাকার অঙ্কে তা ৯ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মাত্র ৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। মোট বরাদ্দের মাত্র ৩৩ শতাংশ। সে হিসাবে এখনো ৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে, যা মাত্র ক’দিন পর ফেরত যাবে।
এ প্রশ্নে কেউই বিতর্ক করবেন না যে, আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এখানে অবকাঠামোগত সমস্যা, ওষুধ পথ্যের সমস্যা, চিকিৎসক ও সেবিকার অভাব এতটা প্রকট অথচ তার প্রতিবিধানে রাজনৈতিক নির্বাহীসহ আমলাদের নিদারুণ উদাসীনতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এর পরিণতিতে জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হচ্ছে হতাশা ক্ষোভ ও প্রশাসনের প্রতি অপরিসীম অনাস্থা। আর যারা পত্রপত্রিকার সচেতন পাঠক, তারা প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে পাঠ করেন স্বাস্থ্যসঙ্কটে পড়ে লাখো মানুষের করুণ আহাজারির খবর। ন্যূনতম চিকিৎসা লাভের ক্ষেত্রে দেশের যে চিত্র তা অনেকটাই অনুন্নত দেশের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
স্বাস্থ্য খাত একটি জাতির সুস্থ বিকাশে বিরাট অবদান রাখে। এই খাতে দুর্দশা যেমন জনগণকে বিমর্ষ করে, তেমনি শিক্ষা খাতের কোনো দুঃসংবাদও জাতির সকল শ্রেণীর মানুষকে ভাবিয়ে তোলে ও হতাশায় নিমজ্জিত করে। এ কথা সবার জানা আমাদের শিক্ষা খাত এখনো কতটা পিছিয়ে আছে। আমাদের উচ্চশিক্ষার যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কোনো প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠের সাথে তুলনায় যাওয়ার সব যোগ্যতা হারিয়েছে। সে যাই হোক আমাদের এখানে যে বিষয়টি পত্রিকান্তর থেকে তুলে ধরতে চাচ্ছি। দেশে এক বছরের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের প্রায় ৮ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ২০২২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির ভিত্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
করোনাকালে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা খাত নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষণা প্রতিবেদনে সেটা উঠে এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সূত্র মতে, ২০২১ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির তথ্য অনুসারে, সে বছর কিন্ডারগার্টেনসহ সব মিলিয়ে ১৪ হাজার ১১১টি বিদ্যালয় কমেছে। এসব তথ্য সূত্রের কোথাও উল্লেখ নেই যে, বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করার কোনো উদ্যোগ মন্ত্রণালয়ের রয়েছে কি না। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই আট হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক লাখ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন কি এখানেই শেষ? কে তার উত্তর দেবে? অথচ প্রতিটি শিশু-কিশোরের জন্য শিক্ষালাভ হচ্ছে তার জন্মগত অধিকার। রাষ্ট্রকে এ দায়িত্ব নিতেই হবে, এখানে কোনো অজুহাত দেয়া চলে না।
আমরা শুনে আসছি, অন্যান্য দেশের তুলনায় নাকি আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো। আমরা আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর রেখে লাভ কী। সেজন্য বলছি কোথায় কী পরিস্থিতি সেটা আমাদের জানার দরকার কী! আমরা আমাদের খবরই রাখতে চাই। একটি জাতীয় দৈনিকের অতি সাম্প্রতিক কালের শীর্ষ এক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে- ‘প্রতিদিন গড়ে ৯ জনের বেশি খুন’ এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দেশে গত এপ্রিল মাস থেকে প্রতিদিন গড়ে ৯.২ জন করে খুন হয়েছে। সেই মাসটিতে মোট ২৭৬ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধ, মাদক, পারিবারিক, অশান্তি, আর্থিক দ্বন্দ্বসহ নানা বিষয়ে বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিকে কোনো মানুষই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। এতে মানুষর মানসিক বৈকল্য সৃষ্টি হতে বাধ্য। সবাইকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে হতাহতের সংখ্যা ইদানীং আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা দেশে বিদেশে আমাদের দেশের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি সাম্প্রতিককালের সব বিবেচনায় এক নম্বর আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এই আলোচনার সূত্রপাত বহু দিন থেকে এবং এখনো সমান গুরুত্ব নিয়ে মূল্যস্ফীতির বিষয়ের আলোচনা সমালোচনা গোটা দেশেই হচ্ছে। এর কারণ মূল্যস্ফীতি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে চলছে। এখন সেটা থেমেছে এমন কিন্তু নয়। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে; দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ব্যয়, বিদ্যুৎ-গ্যাসের খরচ বৃদ্ধি; সব মিলিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি কমা শুরু হলেও বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। নীতিনির্ধারকদের দেখা যাচ্ছে, কার দোষে মূল্যস্ফীতি বাড়লো, সেই বিতর্কের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। এই বিতর্ক, বিতর্কের জায়গায় থাকুক। তবে সাধারণের অবস্থা তো এসব তর্কবিতর্কের মাধ্যমে সুরাহা হবে না। মানুষ এখন বাস্তব পদক্ষেপ দেখতে চাইছে। মূল্যস্ফীতি এখন প্রতিটি মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
এমন দুর্ভোগ হতাশা আর মানুষের মর্মবেদনার অসংখ্য কাহিনী প্রতিদিন বিভিন্ন জাতীয় আঞ্চলিক খবরের কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে। তার কতটা আর তুলে ধরা সম্ভব। সেটা করা হলে সে এক ‘বিষাদ সিন্ধুতে’ পরিণত হবে। এটাই এখন আমাদের এ দেশের মানুষের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ndigantababar@gmail.com