সংস্কার কাজের নামে নয়ছয় বা দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। শুরু থেকেই ছিল। কার্যকর মনিটরিং ও জবাবদিহি না থাকায় নগর গণপূর্ত বিভাগের আওতাধীন এলাকায় সংস্কারের নামে রীতিমতো ডাকাতি কারবার চলছে। প্রাপ্ত অভিযোগ ও সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে যার বেশকিছু প্রমাণও মিলেছে। এ বিষয়ে যুগান্তরকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে চায়নি সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ। এমনকি তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেও তথ্য মেলেনি।
তিন মাস অপেক্ষার পর গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার যুগান্তরকে জানান, নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মন্ডলকে এ বিষয়ে দাপ্তরিক চিঠি দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি। এজন্য দিতে পারছেন না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা সংস্কার কাজসংশ্লিষ্ট প্রতিটি এলাকার কাজ মনিটরিং করার জন্য টিম ভাগ করে দিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন গত রোববার নিজ দপ্তরে প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি যখন এর আগে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলাম, তখন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক মিটিংয়ে বলেছিলাম, বেশির ভাগ সংস্কার কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। সংস্কার কাজের নামে ১০ লাখ টাকা বিল করা হলে বাস্তবে কাজ হয় ৩ লাখ টাকার। ৫ লাখ টাকা ঠিকাদারের কাছ থেকে অগ্রিম তুলে নেওয়া হয়। এছাড়া প্রকল্পের কাজে প্রাক্কলিত দর ২৫-৩০ শতাংশ বাড়িয়ে কৌশলে বড় ধরনের দুর্নীতি করা হচ্ছে। এগুলো এখন শক্ত হাতে দমন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কার কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে আমার কাছে অনেক অভিযোগ আসে। এখন আমি মন্ত্রণালয় থেকে এলাকা ভাগ করে মনিটরিং কমিটি করে দিচ্ছি। এসব কমিটি বাস্তব কাজ যাচাই-বাছাই করে দেখবে। আগের কাজও আমরা যাচাই করব। প্রয়োজনে আমি নিজেও সারপ্রাইজ ভিজিট করব।’
কাজী ওয়াছি উদ্দিন আরও বলেন, একটা বিশেষ সফটওয়্যার জুলাই থেকে কার্যকর করতে যাচ্ছি। এটা অতিরিক্ত প্রাক্কলনের চুরি ঠেকাবে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এটি সফল হয়েছে। অর্থাৎ কোনো প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হলে তা সফটওয়্যার ধরে ফেলবে। এই সফটওয়্যার দিয়ে যে কটা প্রকল্পের দর যাচাই করা হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বাড়তি দর দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই কারচুপি আর চলবে না। সচিব মনে করেন, প্রকল্পের শুরুতেই এটা হলো সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। ফলে যে কোনো মূল্যে এ দুরভিসন্ধী প্রতিরোধ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, সংস্কার কাজের নামে বেশির ভাগ অর্থ লুটপাট হয়। যে কোনো সংস্কার কাজের ক্ষেত্রে কমবেশি লাগামহীন এ দুর্নীতি চলে আসছে। কিন্তু এর মধ্যে নগর গণপূর্ত বিভাগ একেবারে শীর্ষে অবস্থান করছে। এখানে প্রতি অর্থবছরে আবাসিক ও অনাবাসিক মিলে সর্বনিম্ন ৪০ কোটি টাকার বরাদ্দ থাকে। কাজ দেখিয়ে বিল তুলে নেওয়া হয়। মিন্টো রোড, হেয়ার রোড, বেইলি রোড, সচিব নিবাস, বঙ্গভবনসহ এসব ভিআইপি এলাকায় সংস্কার কাজ করে থাকে নগর গণপূর্ত বিভাগ। এখানে দোতলা বাংলো আছে ৪৫টি। বাংলোগুলোয় প্রতিবছর গড়ে বিপুল অঙ্কের সংস্কার কাজ দেখানো হয়। কোনো কোনো ভবনে এর পরিমাণ কোটি টাকার কাছাকাছি। প্রতি অর্থবছরে একই বাসার নামে দুই-তিনবার সংস্কার কাজ দেখানো হয়। অথচ নিয়মানুযায়ী যে বাসায় একবার সংস্কার কাজ হবে, পরের বছর সেখানে আর কোনো সংস্কার কাজ করা যাবে না।
আবার এসব কাজও করে ঘুরেফিরে কয়েকটি প্রভাবশালী ঠিকাদার। কাগজেকলমে ভুয়া কাজ দেখিয়ে বিল তুলে নেওয়ার সংখ্যাও কম নয়। অনেক সময় ঠিকাদারের কাছ থেকে অগ্রিম ৫০ শতাংশ টাকা নিয়ে বাকি টাকার মধ্যে ৩০ শতাংশ কাজ করে বাকি ২০ শতাংশ টাকা ঠিকাদারকে লাভ হিসাবে দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, প্রতিবছর নগর গণপূর্ত বিভাগে বরাদ্দ থাকে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া থোক বরাদ্দ থেকে আরও নেওয়া হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকার সংস্কার কাজ করা হয়। তবে প্রতিটি কাজ ধরে যদি দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা সরেজমিন অনুসন্ধান করেন, তাহলে সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। এগুলো তো ভৌত কাজ। ফলে আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই। চলতি অর্থবছরে গণপূর্ত বিভাগের সারা দেশে সংস্কার কাজের জন্য বরাদ্দ আছে ৮৫০ কোটি টাকা। পুরো বরাদ্দ নিয়ে দুদকের তদন্ত করা উচিত। এছাড়া শুধু গণপূর্ত বিভাগ নয়, সরকারি প্রতিটি দপ্তরের সংস্কার কাজে ব্যাপক লুটপাট হচ্ছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান ও কেস স্টাডি : অভিযোগ পাওয়ার পর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতিবেদক সরেজমিন তিন দিন এসব এলাকার বিভিন্ন বাংলোয় অনুসন্ধান চালান। ভবনের কেয়ারটেকার ও নিরাপত্তা প্রহরীদের সঙ্গে কথা বলে এবং স্বচক্ষে কিছু কাজের নমুনা দেখে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
২৫ বেইলি রোডে একজন প্রতিমন্ত্রীর বাসায় দুই দফায় কাজ দেখিয়ে বিল তুলে নেওয়া হয় প্রায় ৪০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২০২৩) বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার ৪নং সিরিয়ালে এ বাসভবনের সুয়ারেজ লাইন মেরামত/নবায়ন, এসবি কোয়ার্টার ও রিসিপশন কক্ষ মেরামতের জন্য ১৫ লাখ এবং ৪৮নং সিরিয়ালে একই বাসার জন্য পুলিশ ব্যারাক, এসবি কোয়ার্টার ও রিসিপশন কক্ষের মেরামতের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে একই কাজের কথা দুবার বলা হয়েছে। এছাড়া গত অর্থবছরের (২০২১-২০২২) সংশোধিত বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার ৭নং সিরিয়ালে ২৫ বেইলি রোডের একই বাসভবনে পুলিশ ব্যারাক, এসবি কোয়ার্টার ও রিসিপশন কক্ষের মেরামত কাজের জন্য ১৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা বিল তুলে নেওয়া হয়। আবার ৮নং সিরিয়ালে একই বাসার অভ্যন্তরে মূল ভবনের ভেতর ও বাইরে রং করার জন্য খরচ দেখানো হয় ২৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। এখানেই শেষ নয়, এর আগের অর্থবছরেও (২০২০-২০২১) খরচ করা হয়েছে ১১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ভবনের অভ্যন্তরে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার কার্পেটিংয়ের জন্য।
এ বাসায় থাকেন একজন প্রতিমন্ত্রী। বাসার কেয়ারটেকার হাসান যুগান্তরকে বলেন, এত টাকার কাজ করছে কি না বলতে পারব না। মাঝেমধ্যে দেখি টুকটাক কাজ করে। কিন্তু এসব নিয়ে কিছু বলতে পারব না। ছোট চাকরি করি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ।
চলতি অর্থবছরের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনাপত্রের ২৬নং সিরিয়ালে অ্যাটর্নি জোনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিনের বাসায় (ম-১ তটিনী, হেয়ার রোড) বিশেষ নবায়ন কাজের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৬৪ লাখ এবং ৪৩নং সিরিয়ালে মূল ভবনের ভেতর ও বাইরে বিশেষ মেরামতের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। অথচ অর্থবছরের বাকি আছে মাত্র ৩২ দিন। ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এ বছর বাসায় কোনো সংস্কার কাজ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে কর্তব্যরত কেয়ারটেকার ও সিকিউরিটি গার্ডরা কিছুই বলতে পারেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কনস্টেবল বলেন, ‘কিছুদিন আগে সামনের সীমানা প্রাচীর একটু উঁচু করার কাজ হয়েছে। এছাড়া আর কোনো কাজ করতে দেখিনি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের থাকার ঘরে তো অনেক সমস্যা। অনেক বলার পরও মেরামত করে দেয়নি।’
এখানেই শেষ নয়, একই বাসায় এর আগের অর্থবছরে (২০২১-২০২২) বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনাপত্রের ৩৩নং সিরিয়ালে স্যানিটারি ফিটিংস পরিবর্তনসহ ভবনের ভেতর ও বাইরের মেরামত কাজের জন্য ৬০ লাখ টাকার বিল তুলে নেওয়া হয়। এমনকি এই একই বাসায় এর আগের অর্থবছরে (২০২০-২০২১) মূল ভবনের ভেতর ও বাইরে সংস্কার কাজ করা হয় ১১ লাখ ২১ হাজার টাকার।
এসব কাজের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত পাঠিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিনের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন বাসায় উঠেছি, তখন টাইলস ও ওয়ালের কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু এত টাকার কাজ কোথায় কীভাবে করেছে, সেটা আমি ওদের ডেকে এনে জানতে চাইব।’
২০২০-২০২১ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনাপত্রের ৩২ নম্বর সিরিয়ালে ২৪ বেইলি রোডে মন্ত্রীর বাসভবনের রুম বাড়ানো, বুকসেলফ তৈরি এবং ফ্লোরের টাইলস লাগানো বাবদ ব্যয় করা হয় ২৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু একই অর্থবছরে ৫৬নং সিরিয়ালে ভবনের ভেতর ও বাইরে রং করাসহ ব্যয় হয় ১২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। আবার একই অর্থবছরে ৭৩নং সিরিয়ালে খরচ দেখানো হয়েছে ১৫ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, যেসব বাসায় কাজ দেখিয়ে বিল তুলে নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে বেশকিছু বাসায় সরেজমিন তদন্ত করলে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়বে। এর মধ্যে রয়েছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনাপত্রের ৫নং সিরিয়ালে থাকা হেয়ার রোডের ৩৫নং বাংলো, ৮নং সিরিয়ালে থাকা মিন্টু রোডের ৪৪নং বাংলো, ৯নং সিরিয়ালে বঙ্গভবনের অভ্যন্তরে প্রধান কিচেন বিল্ডিং এবং কানেকটিং করিডর মেরামত, রং করা প্রভৃতি সংস্কার কাজ; ২২নং সিরিয়ালে মিন্টু রোডের উভয় পাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, ৩৭নং সিরিয়ালে ১৫৭ পার্ট কাকরাইল সরকারি বাসভবনের সীমানা প্রাচীর, গ্যারেজ ও ড্রাইভার সেড নির্মাণ; ৪১নং সিরিয়ালে ৩৪ মিন্টু রোডের অভ্যন্তরে সুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা মেরামত; ৫৭নং সিরিয়ালে ৩৯ মিন্টু রোডের বাংলোয় গ্যারেজ কাম ড্রাইভার শেড ও উন্মুক্ত গ্যারেজ নির্মাণ; ২৪, ২৫ ও ৩৯ বেইলি রোডে মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্টে সীমানা প্রাচীরের রঙের কাজ; ১০৯নং সিরিয়ালে ইস্কাটনে সচিব নিবাসে ৫২, ৬৯ ও ৭১নং ভবনে সুইপিং মালামাল সরবরাহ; ১১০নং সিরিয়ালে বেইলি রোডে অবস্থিত পিডব্লিউডি স্টাফ কোয়ার্টারের অভ্যন্তরে রাস্তা, ড্রেন ও সুয়ারেজ লাইন সংস্কার প্রভৃতি।
২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮নং সিরিয়ালে ইস্কাটনে সচিব নিবাসের ৬৯নং ভবনের বদলি ও অবসরজনিত কারণে খালি হওয়া ফ্ল্যাটগুলো নতুন বরাদ্দ গ্রহীতাদের কাছে হস্তান্তরের সময় রং করা এবং অন্যান্য জরুরি স্যানিটারি কাজের জন্য ৩০ লাখ টাকা খরচ করা হয়। ৩৬নং সিরিয়ালে সচিব নিবাসের ৭১নং ভবনে রং করা ও জরুরি ফিটিংস ২৪ লাখ টাকা; ৩৭নং সিরিয়ালে একই ভবনে স্যানিটারি, হার্ডওয়্যার ও সুইপিং মালামাল সরবরাহ ১৪ লাখ ৩৬ হাজার এবং ৩৮নং সিরিয়ালে ফের একই ভবনের একই ধরনের কাজের জন্য ব্যয় করা হয় ৩০ লাখ টাকা।
সংশোধিত বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার ৫০নং সিরিয়ালে ৯ মিন্টু রোডের মূল ভবনের বাউন্ডারি ওয়াল নবায়নসহ অন্যান্য কাজের জন্য ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা; ৫১নং সিরিয়ালে ১০ মিন্টু রোডের ভবনের সীমানা প্রাচীর, গ্যারেজ ও পশু শেড, ড্রেন সংস্কারে ১৩ লাখ ৯২ হাজার; ৫৪নং সিরিয়ালে ১১, ৩৪ ও ৩৫নং মিন্টু রোডের ভবনে একই ধরনের কাজের জন্য ১৯ লাখ ৫১ হাজার এবং ৫৬নং সিরিয়ালে ২৮ মিন্টু রোডের বাংলোর অভ্যন্তরে একই ধরনের বিভিন্ন কাজের জন্য ২২ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এভাবে ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ মিন্টু রোডের বাংলো, ৭৫নং সিরিয়ালের ২০ লাখ টাকার কাজ, নীলক্ষেতে অবস্থিত সরকারি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের একাধিক সংস্কার কাজ এবং বঙ্গবভনের বিভিন্ন সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এগুলো তদন্ত করলে বরাদ্দকৃত অর্থ এবং বাস্তব কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক বেরিয়ে আসবে।
এদিকে ইস্কাটনে সচিব নিবাসে গেলে সেখানকার কেয়ারটেকাররা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গেটে কতর্ব্যরত আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো কিছু বললে আমাদের চাকরি যাবে। স্যারদের সঙ্গে কথা বলেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সচিব নিবাস প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই। সরকারের সিনিয়র সচিব, সচিব এবং গ্রেড-১ কর্মকর্তাদের জন্য অত্যাধুনিক সচিব নিবাস উদ্বোধন হয়েছে প্রায় চার বছর। নিয়মানুযায়ী ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত কোনো সংস্কার কাজ সরকারি অর্থে করা যাবে না। এ সময় কোনো সমস্যা হলে ঠিকাদার করবে। এর পরের বছর একেবারে জরুরি ছাড়া সংস্কার বা মেরামতের কোনো কাজে সরকার খরচ করবে না। কিন্তু বাস্তবে গত চার বছরে সংস্কার খাত থেকে সচিব নিবাসের পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
সচিব নিবাসে ছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক সিনিয়র সচিব যুগান্তরকে বলেন, ‘এখানে অর্থ অপচয়ের একটা সরাইখানা। কোনো কর্মকর্তা বাসা ছাড়ার পর আরেকজন এলে সংস্কার কাজের নামে একরকম হুড়োহুড়ি লেগে যায়। দেওয়ালে রং করা প্রয়োজন না হলেও করানো হয়। বাথরুমের ফিটিংস কোনোভাবে পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই; কিন্তু আমাদের কেউ কেউ সেটি পরিবর্তন করান। এছাড়া এসব বিষয়ে একধাপ এগিয়ে থাকেন গণপূর্তের ইঞ্জিনিয়াররা। বড় স্যারদের বেশি খুশি করতে পারলে তারা যেন ধন্য। ফলে আর যায় কোথায়। অপ্রয়োজনীয়ভাবে দামি ফিটিংস লাগানো হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যেটা হয়, ১০ হাজার টাকার জিনিস লাগালে বিল দেখানো হয় ৩০ হাজার টাকা। এজন্য শুধু দায়সারা মনিটরিং করলে হবে না। সব বিষয় সঠিকভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। তিনি জানান, এছাড়া নীরবে আরও একটা অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। সেটি হলো- হাউজকিপিংয়ের জিনিসপত্র একমাত্র মন্ত্রিসভার সদস্যদের জন্য প্রাধিকার। কিন্তু এই হাউজকিপিংয়ের নামে গড়ে বিল তুলে নেওয়া হচ্ছে।
এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য নিতে নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মন্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি। একপর্যায়ে গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার অনুরোধে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে সম্মত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিলের শেষদিকে ওই কর্মকর্তার দপ্তরে তিনি আসেন। সেখানে তিনি নিজেকে একেবারে শতভাগ সৎ কর্মকর্তা হিসাবে দাবি করেন। কান্নাকাটি করে তিনি বলেন, তার বাড়িতে এখনো মাটির ঘর। তিনি একটি পয়সা দুর্নীতি করেন না। এরপর তিনি সত্য রিপোর্ট অনুসন্ধানের স্বার্থে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করা এবং সরেজমিন কয়েকটি কাজ দেখাবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু এক মাস পার হয়ে গেলেও তিনি নীতিগত কোনো সহায়তা করেননি।
কয়েক দফা দিনক্ষণ দিয়েও কোনো কাগজপত্র দেননি। উলটো তিনি রিপোর্ট বন্ধ করার জন্য নানামুখী তদবির শুরু করেন। রিপোর্ট প্রকাশ না করার জোর অনুরোধ জানিয়ে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তিনি প্রতিবেদককে বলেন, রিপোর্ট প্রকাশ হলে তাকে নাকি দেশ ছাড়তে হবে। এছাড়া এসব কাজে কোনো অনিয়মের জন্য তিনি তো একা দায়ী নন। সরেজমিন সব কাজ দেখাশোনা করার কথাও তার নয়।