বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি অবস্থান করছেন সৌদি আরবে। দেশটি থেকে একসময় রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ও আসতো সবচেয়ে বেশি। তবে সম্প্রতি রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে দেশটি। সেই স্থান দখল করে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ কম প্রবাসী থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে হঠাৎ রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে ব্যাখ্যা করে পাচারের অর্থ রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরছে কিনা, এ প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। গতকাল সিপিডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটা একেবারেই আনইউজাল, কখনোই হয় না। কারণ, আমরা জানি আমাদের বেশিরভাগ রেমিট্যান্স মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে। গত ১০ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৯.২২ লাখ মানুষ গেছে।
সেখান থেকে প্রত্যাশা মতো রেমিট্যান্স আসছে না। লোক যাওয়া ও রেমিট্যান্সের মধ্যে মিসম্যাচ হচ্ছে। এতদিন সৌদি আরব থেকে বেশি রেমিট্যান্স এলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন সে জায়গা দখল করেছে। সিপিডি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সৌদি থেকে ৩.৮৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩.০৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ২.৮৭ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩.০৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিকে সন্দেহের চোখে দেখছে সিপিডি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যারা যায় তাদের বেশিরভাগই হোয়াইট কালার জব করে। অনেকেই ঘরবাড়ি ও জমিজমা বিক্রি করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে চলে যায়। অনেক শিক্ষার্থীও সে দেশে আছে। তারা তো আর টাকা পাঠাতে পারে না। তাহলে বিপুল এ রেমিট্যান্স আসছে কোথা থেকে! তিনি বলেন, এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে এমন- যেখান থেকে টাকাটা পাচার হয়েছে সেটা আবার রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফেরত আসছে। রেমিট্যান্সের ওপর যে আড়াই শতাংশ ইনসেন্টিভ বা সাবসিডি দেয়া হচ্ছে সেটার সুযোগ নেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে আরও গভীরে গিয়ে বিষয়টির অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
এদিকে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করা বাংলাদেশি শ্রমিকের পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে সৌদি আরবে ৫৩ লাখ ২৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রে এই শ্রমিকের পরিমাণ আড়াই লাখের কিছু বেশি। তবুও রেমিট্যান্স পাঠানোর দিকে শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে দেশটি। আর সবচেয়ে বেশি জনশক্তি থাকা সৌদি আরব নেমেছে দ্বিতীয় অবস্থানে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী-আয়ের পুরো পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। প্রবাসীদের পাঠানো সবচেয়ে বেশি অর্থ এসেছে সৌদি আরব থেকে ৪৫৪ কোটি ডলার। ৩৪৪ কোটি ডলার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ২০৭ কোটি ডলার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ও কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া প্রবাসী আয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার আয় এসেছে সৌদি আরব থেকে। ২৪০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার নিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী-আয় এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় (১০৭ টাকা দরে) ১ লাখ ৭১ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশটি থেকে এসেছে ২৮০ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২৫১ কোটি ডলার।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরব থেকে এসেছে ২৭৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে দেশটি থেকে ৩৪৮ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। গত বছরের তুলনায় এই বছরের একই সময়ে দেশটিতে ৩৬ শতাংশ বেশি জনশক্তি রপ্তানি হলেও রেমিট্যান্স কমেছে ২০.৮৪ শতাংশ।
রেমিট্যান্স সংগ্রহে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটিতে বর্তমানে জনশক্তির পরিমাণ ২৫ লাখের বেশি। কিন্তু চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত এ দেশ থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২২০ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ১২৬ কোটি ডলার। চলতি বছর দেশটিতে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার জনশক্তি রপ্তানি হলেও রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭৪ শতাংশ।
রেমিট্যান্স সংগ্রহে চতুর্থ অবস্থানে যুক্তরাজ্য। দেশটিতে অবস্থান করা বাংলাদেশির পরিমাণ সাড়ে ৯ লাখ। তবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, কর্মরত বাংলাদেশির পরিমাণ মাত্র ১১ হাজার ৩৮৮ জন। অথচ দেশটি থেকে গত মার্চ পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ১৪৬ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এটি ১ কোটি ডলার কম ছিল। অর্থাৎ এক বছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ০.৭৬ শতাংশ।
রেমিট্যান্সের শীর্ষ পাঁচে অবস্থান করা অন্য দেশটি হচ্ছেÑ কুয়েত। দেশটিতে বর্তমানে সাড়ে ৬ লাখের বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন। এসব বাংলাদেশি চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১১৯ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১২৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমেছে ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর পরিবেশ থাকায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ কমছে। আর মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা দক্ষ কম হওয়ায় আয়ও কম। বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠালে তারা ১০৭-৯ টাকা পাচ্ছে। অথচ হুন্ডিতে পাঠালে পাচ্ছে ১১৫-১৮ টাকা। তাই তারা হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। আর পশ্চিমা দেশগুলো থেকে হুন্ডি সহজ নয়। এ ছাড়া ওই দেশগুলোতে যাওয়া বাংলাদেশিদের অধিকাংশই শিক্ষিত ও সচেতন। তাই তারাও রেমিট্যান্স হুন্ডিতে কম পাঠায়।
ব্যাংকাররা জানান, আমেরিকায় যারা থাকেন, তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। তাদের আয় পাঠানোর কথা নয়। মূলত অবৈধ ও বৈধ অনেক অর্থ দেশটিতে পাচার হয়ে গেছে। অনেকে সেই অর্থ বৈধ করতে দেশে এখন ফিরিয়ে আনছেন। এখন ডলারের দাম বেড়েছে, পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আনলে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। ফলে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। পাশাপাশি দেশটিতে থাকা প্রবাসীদের আয়ও বেশ ভালো। অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়াও বেশ সহজ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হুন্ডি এখনো হাতের নাগালেই রয়েছে। ফলে জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও দেশগুলো থেকে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা বাড়ছে না।
গত বৃহস্পতিবার বিআইডিএস আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, সরকার এবং ব্যাংক চাইলেও হুন্ডির সঙ্গে পারা সম্ভব নয়। হুন্ডিকে কীভাবে প্রপার চ্যানেলে আনা যায় সেজন্য ভারতকে অনুসরণ করে অ্যাপসের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনার কাজ করা হচ্ছে।