‘মোর ভাগ্যডা খারাপ। হগলের পোলা-মাইয়া পরীক্ষা দিয়া বাড়ি যায়। আর মোর মাইয়াডা এহন সংসার করে। ইচ্ছা আছিল পড়াশুনা করাইয়া মানুষ করমু, হেইয়ার পরে বিয়া দিমু। মোর কপালে আর হেই সুখ নাই! করোনায় হালের গরু দুইডা মারা যাওয়ার পর ঘরে শনির দশা লাগছে।’ এভাবেই বলছিলেন পটুয়াখালীর বাউফলের কৃষক জাহাঙ্গীর আকন। দারিদ্র্য যুদ্ধে টিকতে না পেরে জাহাঙ্গীর তাঁর দাখিল পরীক্ষার্থী মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছেন। মেয়েকে বালিকা বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে তুলে জাহাঙ্গীর এখন হাপিত্যেশ করলেও অনেক অভিভাবক আবার বাল্যবিয়ে দিয়ে তৃপ্তি খোঁজেন। তেমনই একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ধরমণ্ডল উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীর বাবা। এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর আগের রাতে বাজে ওই ছাত্রীর বিয়ের সানাই। হুট করে এ বয়সে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ওই বাবা বলেন, ‘ভালা আলিম (মাওলানা) জামাই পাইছি। তাই বিয়া দিয়া দিছি। এত পড়ালেহা কইরা কিতা করব? পড়ালেহা কইরা তো জামাইর ভাতই রান্দন (রান্না) লাগব!’
দারিদ্র্যের বৃত্তে আটকে বাল্যবিয়ের মুখে পড়ে নীরবে এভাবেই স্কুল ছাড়ছে অসংখ্য বালিকা। অন্যদিকে অভাবী ঘরের ছেলেরা সংসারের ঘানি টানতে কিশোর বয়সেই জড়িয়ে পড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। ফলে পড়াশোনায় পড়ছে ছেদ। দশম শ্রেণিতে উঠেও অনেকের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা হচ্ছে না।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গত ২১ মে পর্যন্ত অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। যদিও পরীক্ষার বিষয় ও পত্রভেদে এ সংখ্যা কমবেশি হয়।
৩৮ হাজার অনুপস্থিত সারাদেশে একযোগে গত ৩০ এপ্রিল মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়। ১১ শিক্ষা বোর্ড থেকে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১০ লাখ ২১ হাজার ১৯৭ এবং ছাত্রী ১০ লাখ ৫০ হাজার ৯৬৬ জন। ৩৮ হাজার অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে, ১১ হাজার ৩৮৩ জন।
বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে অনুপস্থিতির হার এবার চোখে পড়ার মতো। ১৪ মে অনুষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞান, বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ে ১১ হাজার ৬০৯ জন পরীক্ষায় বসেনি। এই তিন বিষয়ে অনুপস্থিতির হার ১ দশমিক ১৭ শতাংশ। ১৬ মে রসায়ন বিষয়ে গরহাজির ছিল ১৫ হাজার ৪৭২ জন। এই হার মোট পরীক্ষার্থীর ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। ১৯ মে অনুষ্ঠিত জীববিজ্ঞান পরীক্ষায় ৫ হাজার ৮০০ জন অনুপস্থিত ছিল। সর্বশেষ ২১ মে বিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিত পরীক্ষায় সারাদেশে ১৬ হাজার ১৫২ জন অনুপস্থিত ছিল।
অনুপস্থিতির হার ১ দশমিক ১৩ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনুপস্থিতর এই সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। করোনার আগে ২০১৭ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল ৮ হাজার ৫২০ জন। ২০১৮ সালে ৯ হাজার ৬৪২, ২০১৯ সালে ১০ হাজার ৩৮৭, ২০২০ সালে ১২ হাজার ৯৩৭, ২০২১ সালে ১৮ হাজার ৮২০ এবং ২০২২ সালে ৩৫ হাজার ৮৬৫। আর এ বছর ৩৮ হাজার অনুপস্থিতি ধরলে ২০১৭ সালের চেয়ে তা পাঁচ গুণের কাছাকাছি।
কেন ঝরে পড়া বাড়ছে
পরীক্ষায় কেন শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি বাড়ছে? এই উদ্বেগজনক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে সমকাল। দারিদ্র্য আর বাল্যবিয়ের কারণেই মূলত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষা থেকে দূরে থাকছে। অসুস্থতা ও পরীক্ষা খারাপ হওয়ার কারণে অনুপস্থিতির ঘটনাও আছে। এ ছাড়া খুব সামান্য কিছু শিক্ষার্থী কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার হওয়ার কারণেও পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে আর উপস্থিত থাকছে না।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে করোনার মধ্যে দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। এর মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়ে যায়। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয় প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে মাউশি সে সময় দেশের ২০ হাজারের মধ্যে ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিল।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাল্যবিয়ের হারে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। প্রতিবেদনে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর চান্দপুর মিয়াচাঁন শাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তাঁর বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন করেছিল এমন ১২ জন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে না। এর মধ্যে ১০ জনই ছাত্রী, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। হোসেনপুরের গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আফাজুর রহমান খান জানিয়েছেন, তাঁর বিদ্যালয় থেকে নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন করেছিলেন এমন ৩০ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে না। তাদের মধ্যে অন্তত ১২ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।
ভোলার চরফ্যাশনের ৫ হাজার ১১৭ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৯৭ জন এবার পরীক্ষার হলে আসেনি। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬১ জনই ছাত্রী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে এখন পর্যন্ত ৪২ ছাত্রী পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তারা সবাই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা নিশ্চিত করেছেন। একই জেলার আশুগঞ্জে এ বছর ২৬ ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। তাদের অর্ধেকের বেশি ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বিয়ে হওয়ার পরও পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে কেউ কেউ।
কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বাল্যবিয়ের শিকার ২২ শিক্ষার্থী পরীক্ষার টেবিলে বসেনি।
যশোরের কেশবপুরের বুরুলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২৫ পরীক্ষার্থীর মধ্যে আটজন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একজন ছেলেও রয়েছে। পুরো উপজেলায় এবার ৯১ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ জনই ছাত্রী। একাধিক প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়োজিত কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না, তাদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে।
এদিকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুপস্থিতির হার উদ্বেগজনক হলেও তা মানতে নারাজ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। তিনি বলেন, শুধু সংখ্যা দিয়ে বিচার করলে হবে না, শতাংশের হিসাব দেখতে হবে। আমাদের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মোট পরীক্ষার্থীর এক থেকে দেড় শতাংশ অনুপস্থিত সব সময়ই ছিল। এটা উদ্বেগজনক নয়।
এ বছর অনুপস্থিতির সংখ্যা বাড়ার কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি এবার বেশি। যে কারণে সার্বিকভাবে অনুপস্থিতি বেড়ে গেছে। কেউ একটি পরীক্ষা খারাপ করলে পরেরগুলো আর দেয় না। অনেকে আবার দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ের কারণে ঝরে যায়। অসুস্থতার কারণেও কেউ কেউ রেজিস্ট্রেশন করলেও পরীক্ষা দিতে আসে না।
সিলেট শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রমা বিজয় সরকার বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, কারও গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের পরীক্ষা খারাপ হলে বাকিগুলো ড্রপ হয়ে যায়। একজনের দেখাদেখি তাদের বন্ধুরা অনেকেই এই কাজ করে। দারিদ্র্য তো রয়েছেই।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জামাল নাছের বলেন, করোনার সময় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রভাবে ছেলে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ শ্রমঘন কাজে জড়িয়ে পড়ে, এটা সত্যি। আর মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিয়ে দেওয়া হয়। অথচ দারিদ্র্য কাটাতে গেলে শিক্ষাটাই আগে দরকার।