সরকারের পরোক্ষ করের ওপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণে প্রতিনিয়ত নি¤œ আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে বলে উঠে এসেছে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নতুন এক গবেষণায়। ক্রিশ্চিয়ান এইড-এর সহায়তায় ওয়েভ ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন ইন বাংলাদেশ: হোয়াই অ্যান্ড হাউ?’- শীর্ষক গবেষণাটি ‘প্রোমোটিং সিটিজেনস পার্টিসিপেশন ফর প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের একটি অংশ। গবেষণায় বলা হয়েছে, পরোক্ষ কর সমাজের স্বচ্ছল অংশের তুলনায় নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ কেড়ে নিচ্ছে। কারণ যে মানুষের দৈনিক আয় ২০০ টাকা, তার ওপরও পণ্য কেনায় ভ্যাটের প্রভাব ১৫ শতাংশ। আবার যার আয় ২ থেকে ৫ হাজার টাকা, তারও ওই একই হারে ভ্যাট প্রদান করতে হয়। অর্থাৎ, এই পরোক্ষ করের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দরিদ্রদের প্রতি প্রত্যাবর্তনশীল; কারণ ভ্যাট সমাজের একটি সচ্ছল অংশের তুলনায় দরিদ্র মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ কেড়ে নেয়।
এদিকে, বাজেটে ধনী ও দরিদ্রদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে গবেষণায় বলা হয়েছে, মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ ধনীর শ্রেণিভুক্ত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের অর্থায়নের উৎস হিসেবে আয়কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১,২০,৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৭.৮৩ শতাংশ। কিন্তু আয়কর দিয়েছেন টিআইএন ধারীদের মাত্র ৩৩ শতাংশ। অথচ মোট জনসংখ্যার ১৮.৭ শতাংশই অতি দরিদ্র। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের অর্থায়নের উৎস হিসেবে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩,৭০,০০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫৪.৬ শতাংশ। অর্থাৎ, আয়কর প্রদান না করলেও দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও ভোক্তা হিসেবে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ মূসক, পণ্য আমদানিতে পরোক্ষ কর, সম্পূরক শুল্কসহ অন্যান্য ভ্যাট, চার্জ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কর প্রদান করে থাকেন। অর্থাৎ, জাতীয় বাজেটেও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় আরও বলা হয়, কর ব্যবস্থায় দাপ্তরিক জটিলতা, হয়রানি ও অদক্ষতার কারণে যারা প্রত্যক্ষ কর প্রদান করতে চান তারাও কর ব্যবস্থা সম্পর্কে ভীতি ও অসন্তোষ ধারণ করেন। এসবের ফলে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় কম হয়। এর প্রভাব সরাসরি জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হয়। প্রতি বছর দেশের বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিষেবা অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ে। ‘প্রোমোটিং সিটিজেনস পার্টিসিপেশন ফর প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন প্রকল্প’ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সম্প্রতি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সমীক্ষায় আলোচিত বিষয়গুলোর ওপর বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন প্রকল্প কর্মকর্তা খন্দকার তাহসিন আশরাফি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারেক এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন।
আলোচনায় এনবিআরের কর আহরণ সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বৈষম্য হ্রাস করে কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ, কর ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা, কর প্রক্রিয়ার সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ, কর প্রক্রিয়া প্রগতিশীল করা, কর পরিশোধের বিপরীতে নাগরিকরা কী পরিষেবা পাচ্ছে সে বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া চালু করার বিষয়গুলো উঠে আসে।
প্রকল্প কর্মকর্তা খন্দকার তাহসিন আশরাফি সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে কর ন্যায্যতা ও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছে। সামাজিক বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয়ের ব্যবস্থা ও অনুশীলনকে শক্তিশালী করা এবং সমাজের ধনী ও সক্ষম ব্যক্তিদের নিকট থেকে উপযুক্ত পরিমাণ কর আদায়ের মাধ্যমে সেবা কার্যক্রমে বাড়তি বরাদ্দ প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট নীতির সংস্কার করতে হবে। এছাড়া উচ্চস্তরে কর-জিডিপি অনুপাতিক হারে বৃদ্ধি করা, কর অব্যাহতি কমানো, কর সম্পর্কিত তথ্যের অভিগম্যতা (এনবি আর ডেটা সেন্টার) বাড়ানো, বিনিয়োগ আয় এবং সম্পদের ওপর করহার (যেমন- সম্পত্তি, সম্পদ, এবং উত্তরাধিকার) বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে পরামর্শ তুলে ধরা হয়।