-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
বাংলাদেশে মন্ত্রীর সংখ্যা কত বলতে পারি না। দেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাপার শাসন আমরা দেখেছি। এসব শাসনকালে কত লোক যে মন্ত্রী হয়েছেন তা গণনা করা প্রায় অসম্ভব। কত মন্ত্রীর যে নাম জানি না, চেহারা চিনি না তা বলতে পারি না। কেউ কেউ অন্ধকার থেকে আলোতে আসেন নানা ধরনের কান্ড করে। কেউ আসেন বাস ড্রাইভারকে মারপিট করে, কেউবা চিত্রনায়িকাকে অশালীন কথা বলে। কেউ প্রধানমন্ত্রীর যাত্রা সঙ্গী হয়ে বিমানে বসে সেলফি তুলে আমাদের জানান দেন যে, আমরা মন্ত্রী। তবে অনেক মন্ত্রী সামনে এসেছেন কটূকথা বলে। কেউ বা সন্তানদের অসঙ্গত দাবি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে খবরের শিরোনাম হন। বর্তমান সময়ে এসব বাড়াবাড়ির কারণে মন্ত্রীত্বও হারিয়েছেন কেউ কেউ। ফলে কে মন্ত্রী, কে মন্ত্রী নন, এ নিয়ে সাধারণ মানুষ ভাবে বলে মনে হয় না।
দ্রব্যমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, র্যাব, পুলিশের ভয় এ নিয়ে দিন চলে সাধারণ মানুষের। প্রতিনিয়ত নির্যাতিত, নিষ্পিষ্ট মানুষের হাহাকারই আমরা কেবল শুনি। বিচার নেই। সে জন্য রাতদিন কেবল আল্লাহ তায়ালার কাছে ফরিয়াদ জানানো। কোনো মন্ত্রী,হাফ মন্ত্রী যদি কিছু বলেন তা কেবলই সবকিছু সরকারের গুণগান। যেসব মন্ত্রী বেশি বেশি প্যাচাল পাড়েন, তারা নিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কে কিছু বলেন না। সারাক্ষণ বিএনপি বা জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে হক না হক কথা বলেন। তাদের যদি বর্তমান সময়ে দশটা খুনের কথা বলা হয় তবে তারা চট করেই বলেন বিএনপি’র আমলে কী হয়েছিলো? বিএনপি’র কী হয়েছিলো। বিএনপি’র আমলে যদি দুইটি খুন হয়ে থাকে তবে এ সরকারের আমলে বিশটি খুনও জায়েজ নয় কেন? এমনি হাজারো রকম কূটচাল করেন তারা। মন্ত্রীদের কেউ বাজারে যান না। বাজারের কথা বললে রাগান্বিত হয়ে গালি-গালাজ করেন। দ্রব্যমূল্যের কথা বললে এক কথা বলেন, সারা বিশে^ই জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ফটাফট উদাহরণ দেন সেখানেও নাকি দাম বেড়েছে। কত বেড়েছে সে কথা কখনো বলেন না। কিন্তু প্রবাসীরা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জিনিসপত্রের দামের হিসাব পাঠান। আমরা জেনে যাই কত অসত্য বলছেন আমাদের মন্ত্রীরা।
ক’দিন আগে গত ১১ই মে শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার একটি সেমিনারে ব্যতিক্রমী বক্তব্য রেখেছেন। আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ বাজারে পণ্যের যে দাম তার পকেটে সেই টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট। আমাদের চিনির অভাব নেই। আমাদের চাল, ডাল, তরিতরকারীর অভাব নেই।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সুগার মিলের আখচাষি তারাই সে মিলের শ্রমিক। যে কারণে মিলগুলোয় লুটপাট হয়েছে। আর লুটপাটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের চিনির মিলগুলি যথারীতি চালাতাম, তবে বাজারে চিনির দাম এতো বাড়তো না। এখন চিনি স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। চিনি খুঁজে পাওয়া যায় না। এগুলো হতো না। একইভাবে আমাদের এস.এম.ই খাতের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যারা মুড়ি চানাচুর বিক্রি করে চলতেন। সেখানেও দেশের বড় বড় কোম্পানী হাত বাড়িয়েছে। ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। উন্নত দেশ হওয়ার ক্ষেত্র এস.এম.ই ফাউন্ডেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশে যদি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা থাকে তবে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের উত্তরোত্তর এগিয়ে নিতে হবে। অপচয় বন্ধ করতে পারলে টাকা কোনো বিষয় না। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম তিন মন্ত্রীর আমলেও একটি গুদাম নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি। এটা মন্ত্রীদের দোষ নয়, আমলাদের দোষ।
তিনি বলেন, শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা এখন মন্ত্রী। সবাই টাকার পেছনে ঘুরছেন। সব কথা বলতে গেলে দেখবেন, আমার লাশটা রাস্তায় পড়ে আছে। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, লুটপাট অর্থনৈতিক দুরবস্থা, খেলাপি ঋণসহ স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে খোলামেলা আলাপ করেছেন জনাব মজুমদার। তার নিজের কাজকর্ম সম্পর্কে তিনি বলেন, তার মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯ সংস্থা আছে। কোনো সংস্থার চেয়ারম্যান হেড। এখানে যে আইন আছে সে অনুযায়ী সংস্থার হেডরাই সব ক্ষমতার অধিকারী। মিনিস্টার হিসেবে একটা পিয়নের চাকরি দেওয়ার ক্ষমতাও আমার নেই। আর চেয়ারম্যান ইচ্ছে করলে একদিনে ১০ জনকে নিয়োগ দিতে পারেন। মন্ত্রী কাউকে চাকরি দিতে চাইলে চেয়ারম্যানকে বলতে হয়। এই আইনগুলোর পরিবর্তন করতে হবে। আইনের পরিবর্তন না হলে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা লুটপাট দমানো যাবে না। তারা আমার কথা না শুনলে কিছু করার নেই। সব ক্ষমতা চেয়ারম্যানের?
পঞ্চাশ কোটি টাকার বেশি কাজ সেই মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। মন্ত্রীদের অনুমতি নিতে হয়। এখন তারা ভেঙে ভেঙে টেন্ডার করে। তাহলে আর আমাদের কাছে আসতে হবে না। স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নেই। স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার জন্য আমি একাধিক বার বলেছি। যেমন আমাদের সুগার মিলিগুলো লুজিং কনসার্ন। যারা কৃষক তারাই শ্রমিক। যা ইচ্ছে তাই করছে। যেখানে কর্মকর্তা কর্মচারি লাগার কথা না সেখানে লোক নেয়া হয়েছে। ছয়মাস আখের মৌসুম। বাকি ছয়মাস কাজ না থাকলেও কর্ম চারিদের বেতন-ভাতা, ওভারটাইম দিতে হচ্ছে। এমন পদ আছে যার নাম ‘কানামনা’Ñ এদের কাজ হচ্ছে ঘুরে ফিরে খাওয়া। যেখানে দশজন লোক দরকার সেখানে লোক আছে একশ। এর আগে সুগার মিলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন একজন। সে যদি আর কিছুদিন থাকতো তাহলে মিলের যন্ত্রপাতি লোহা-লক্করসহ বিক্রি করে দিতে। অনেক জায়গা থেকে টেলিফোন আসার পরও আমি তাকে সরিয়েছি। দীর্ঘদিন ধরে জমতে জমতে বড় অংকের ঋণ হয়ে গেছে। আমি অর্থমন্ত্রীকে বলেছি, আপনারা এতো ঋণ মত্তকুফ করে দিচ্ছেন। সুগার মিলের ঋণটা মওকুফ করে দেন। দেখেন সুগার মিলে লাভ হয় না লস হয়।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের একটি ফার্মাসিটিক্যাল প্রতিষ্ঠানে বিদেশি শেয়ার হোল্ডাররা চলে যাবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেরা এ শেয়ার রাখবো। হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে গেল। জার্মানির অংশটা কিনে নিলো স্থানীয় একটা ওষুধ কোম্পানির মালিক। আমাদের আর দিলো না। পরে তিনি পুরোটাই দাবি করে বসেন। আমরা মন্ত্রী-সচিব পর্যন্ত তার পক্ষে নোট দিয়েছি। আমার কাছে ফাইল আসার পর আমি উল্টো নোট দিয়েছি। বলেছি বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ঐ প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে থাকা দরকার। মন্ত্রী আমাকে ঐ ব্যবসায়ীর পক্ষে লিখতে বললেন। আমি শুনিনি। পরে আমার নোট অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। আমাদের অনেক সংস্থা আছে তাদের কোনো ফাইল আমাদের কাছে আসে না। তাদের কেবল ছুটিছাটার ফাইল আমার কাছে আসে।
অনিয়মগুলো করছে প্রধানত আমলারা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ মিটিং এ আমি বললাম সারের সিন্ডিকেট আছে। পোটন তখন দাড়িয়ে বললেন, আপনি সব সময় সিন্ডিকেটের কথা বলেন। তারা এই বক্তব্য আমাকে প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। পরেতো সিন্ডিকেট ধরা পড়েছে। পোটন এখন পালিয়েছে।
কামাল মজুমদার বলেন, পণ্যমূল সামাল দেয়া তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ। মন্ত্রণালয় তাহলে কী করছে? মন্ত্রণালয়টি সরকার ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এটি বাণিজ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করুন। তার নিজেরও তো ব্যবসা আছে। খাদ্যমন্ত্রী নিজেই চালকলের মালিক। মন্ত্রীদের ভেতরেও একটা সিন্ডিকেট আছে। ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন আপনি মন্ত্রী। তাহলে আপনি সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে পারছেন না কেনো। আমাকে তো দায়িত্ব দেয়নি। মন্ত্রী হলো মন্ত্রণালয়ের অল ইন অল। সচিব আর মন্ত্রী। আমিতো মাঝখানে বসে আছি এমনিতেই। তার পরও সত্য বলতে গেলে থামিয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, এক সময় যারা খালি ব্রীফকেস নিয়ে ঘুরতো এখন তারা ব্যাংকের মালিক। এই ব্যবস্থা ভাঙ্গা সর্ম্পকে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এজন্য স্পেশাল ট্রাইবুনাল করা উচিত।
শিল্প প্রতিমন্ত্রীর রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে খুব একটা সুনাম নেই। মন্ত্রী হওয়ার আগে তার বরং দুর্নামই বেশি ছিলো। কিন্তু তিনি যে মন্ত্রণালয় সর্ম্পকে উপলদ্ধি করেছেন, মন্ত্রণালয় আমলাদের প্রভাবে কিভাবে চলে সেটিও জানিয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে কখনো সাধারণ মানুয়ের ভাগ্যের প্ররিবর্তন হবে না। আমলারাই সব লুটেপুটে খাবে।