মুহাম্মদ নূরে আলম: কক্সবাজারের টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরে গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে টানা সাড়ে তিন ঘণ্টার বৈঠক করেছেন মিয়ানমার থেকে আসা দেশটির ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে প্রত্যাবাসনের পক্ষে নানা যুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরে তারা। কিন্তু রোহিঙ্গা নেতারা নাগরিকত্ব প্রদান, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটাতে পুনর্বাসন, স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দাবি করে বলেন, এসব দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির থেকে রাখাইনে ফিরতে রাজি হবে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসন হবে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, কাউকে জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে না। প্রত্যাবাসন বিষয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামতকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবহিত করা হচ্ছে। এদিকে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের আওতায় এ বছরের মধ্যে ছোট পরিসরে হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে চীন। আজ শনিবার ২৭ মে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে চীনের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইডং এ প্রসঙ্গে গুরুত্ব দেবেন। গত মাসে অনেকটা নীরবে ঢাকা ঘুরে যান চীনের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত দেং শিজুন। এর দুই সপ্তাহ পরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য ১৮ এপ্রিল কুনমিং যান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব। ফলে ২৭ মে দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আলোচনা হবে। এছাড়াও গত ২০ মে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগে আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গারা সবশেষ সেখানে থাকবেন সেই ক্যাম্প (ঘাট) পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রে গতকাল জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথমার্ধে চীনের পক্ষ থেকে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক আয়োজনের প্রস্তাব করা হয়। আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য দুই মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বেইজিং থেকে কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার এটি দ্বিতীয় ঢাকা সফর। অবশ্য এর আগে গত জানুয়ারিতে ঢাকায় সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেছিলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং। গত মাসে অনেকটা নীরবে ঢাকা ঘুরে যান চীনের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত দেং শিজুন। এর দুই সপ্তাহ পরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য ১৮ এপ্রিল কুনমিং যান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব। ফলে ২৭ মে দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আলোচনা হবে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। যদিও এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলে রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ভন্ডুল হয়।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার-আরআরআরসি কার্যালয় সূত্রমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের অপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করেন।
প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের জন্য তাদের (রোহিঙ্গা) ২০ জনের প্রতিনিধিদলকে ৫ মে রাখাইনের পরিস্থিতি দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। এখন টেকনাফে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে মিয়ানমার। ৫মে টেকনাফের রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল রাখাইন রাজ্য ঘুরে এসে গণমাধ্যমকে জানায়, প্রত্যাবাসন শুরু করার মতো পরিস্থিতি সেখানে রাখাইনে নেই। মংডুতে কয়েকশ’ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসনের জন্য দুটি ‘মডেল ভিলেজ’ নির্মাণ করা হলেও সেখানে রোহিঙ্গারা থাকতে রাজি হবে না। প্রত্যাবাসন শুরুর আগেই নাগরিকত্ব প্রদানের ঘোষণা দিতে হবে মিয়ানমারকে। প্রত্যাবাসনের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জন করতে ১৪ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধিদলটি গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টায় নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ পৌঁছান। এরপর প্রতিনিধিদলের সদস্যরা টেকনাফের জাদিমুরা ও পাশের শালবাগান রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেন। এই দুটি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা রয়েছে প্রায় ৭০ হাজার। বৈঠক শেষে বেলা সাড়ে তিনটায় দলটি মিয়ানমারে ফিরে গেছে। শালবাগান আশ্রয়শিবিরে একটি সেন্টারে ২৮০টি রোহিঙ্গা পরিবারপ্রধানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের যে ১৫টি গ্রামে পুনর্বাসনের প্রকল্প এবং সেখানে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকবে সে সম্পর্কে তুলে ধরে। প্রতিনিধিদল জানায়, রোহিঙ্গারা রাখাইনে পৌঁছার পর তাদেরকে প্রথমে এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফেকেট) দেওয়া হবে। পরে নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হবে। তখন স্বাধীনভাবে চলাফেরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ চাকরির সুযোগ-সুবিধা পাবে রোহিঙ্গারা। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির মিনিস্ট্রি অব সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ। এই দলের সঙ্গে যুক্ত হন ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতাবাসের কর্মকর্তা অং ক্যা মি। বৈঠকে অন্তত ১৫-১৬ জন রোহিঙ্গার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতারা।
এ সময় কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা প্রতিনিধিদলের উদ্দেশে বলেন, প্রত্যাবাসন শুরুর আগে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এনভিসির পরিবর্তে এনআইডি দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিজ ভিটা-বাড়িতে পুনর্বাসন করতে হবে। মিয়ানমারের ১৩৫ সম্প্রদায়ের মানুষের মতো রোহিঙ্গাদের চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে। অন্যথায় কোনো রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি হবে না।
বৈঠক শেষে রোহিঙ্গা মোহাম্মদ তাহের ও রহিমা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, এত বৈঠকের দরকার কী? মিয়ানমার সরকার যদি সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায়, তাহলে নাগরিকত্ব প্রদান এবং নিজ গ্রামে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেই হয়। এই দুটি দাবি মেনে নিলে কক্সবাজারের সব রোহিঙ্গা দল বেঁধে রাখাইনে ফিরে যাবে।
বৈঠকে উপস্থিত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টার বৈঠকে কিছু রোহিঙ্গা ফিরে যাওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক এবং কিছু রোহিঙ্গা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এর মধ্যে যারা ইতিবাচক, তাদের নিয়ে শিগগিরই প্রত্যাবাসন শুরু হবে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের বুঝাতে চেয়েছেন এনভিসি কার্ড দিয়ে ফেরত নিলেও তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। শরণার্থী কমিশনার বলেন, মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনাকালে রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব, ভিটেমাটি ফেরতসহ বেশ কিছু চিরাচরিত দাবি জানিয়েছে। তিনি বলেন, নাগরিকত্ব, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন রোহিঙ্গারা। এ সময় মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের দাবি পূরণ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ সময় রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘নেগেটিভ-পজিটিভ’ দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন স্বেচ্ছায় যেতে আগ্রহীদের তালিকা করেই রাখাইনে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংসের মহাপরিচালক মাইনুল কবির। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সবাইকে জানিয়েই এই প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। কাজেই এতে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো চাপ নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার উইং) মাইনুল কবির বলেন, এই সমস্যার একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গাদের টেকসই এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন। শিগগির রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু। গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছিল। সে সময় প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে ফিরে যায় দলটি।
জানা গেছে, বাংলাদেশ সফরের সময় চীনের ভাইস মিনিস্টার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এ ছাড়া তিনি পদ্মা সেতু পরিদর্শনে যাবেন। পদ্মা রেলসেতুতে অর্থায়ন করছে চীন। বেইজিং বাংলাদেশের এই রেলসেতুকে তাদের অঞ্চল ও পথের উদ্যোগের (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভবি আরআই) একটি অংশ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মূলত পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে চীনের উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে পরিস্থিতি আলোচনায় আসবে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে কিনা এটাকে একটি জটিল বিষয় হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ এবং প্রত্যাবাসন নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন করেছে যারা বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাস করছে। ১১০০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েই চীনের মধ্যস্থতায় বর্ষা মৌসুমের আগে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাইছে। তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নির্ভর করছে মিয়ানমার প্রত্যাবাসনে সহায়ক পরিবেশ প্রদান করছে কিনা, রোহিঙ্গাদের সদিচ্ছা আছে কিনা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার মনোভাব আছে কিনা।