করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ চলমান রয়েছে। এতে অনেক দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে পোশাক খাতের ওপর। অথচ এ পোশাক খাতই রফতানি আয়ের ৮৫ ভাগ দখল করে আছে। এমনি পরিস্থিতিতে পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ব্যাপক হারে পোশাক রফতানি কমে গেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত দেশের রফতানি আয়ের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। এতে ডলার সঙ্কট প্রকট আকার দেখা দেবে। এ অবস্থায় বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, কমপক্ষে ১০ থেকে ১২টি পণ্য থাকা প্রয়োজন, যা থেকে সমান হারে না হলেও কাছাকাছি রফতানি আয়ে অবদান রাখতে পারে। এ জন্য বিদ্যমান নীতিসহায়তা সংশোধন করে বিনিয়োগবান্ধব নীতিসহায়তা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
তৈরী পোশাক খাতের সামগ্রিক রফতানির অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তিন মাস অন্তর প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। সর্বশেষ এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয় গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের তথ্য নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, তিন মাসে দেশে যে পরিমাণ রফতানি আয় হয়েছে তার প্রায় ৮৬ শতাংশের অবদানই পোশাক খাতের। এর মধ্যে ওভেনে ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং নিট ওয়্যারে ৪৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ২.০৯ শতাংশ, কৃষিভিত্তিক পণ্যে ১.৫৩ শতাংশ, পাটজাত পণ্যে ১.২৭ শতাংশ, রাসায়নিক পণ্যে শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং বাকি ৭.৯৩ শতাংশ অন্যান্য পণ্য থেকে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, তিন মাসে মোট পোশাক রফতানি হয়েছে এক হাজার ২৭২ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে ইউরোপিয়ানভুক্ত ৯টি প্রধান দেশে প্রায় ৭১ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পোশাক রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে ২২৭ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট পোশাক রফতানির প্রায় ১৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানি হয়েছে জার্মানিতে প্রায় ১৯৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট পোশাক রফতানির প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে পোশাক রফতানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ, স্পেনে হয়েছে পৌনে ৭ শতাংশ এবং ফ্রান্সে পোশাক রফতানি হয়েছে ৬.৫৯ শতাংশ।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, যেকোনো কিছু একক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকি বাড়ায়। রফতানি আয়ের ৮৫-৮৬ শতাংশ পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা এ ঝুঁকির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে ওই সব দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ওপর প্রভাব পড়েছে। আর এ জন্য কেনাকাটা কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক কম কমলেও সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে রফতানি আয়ের ওপর। এর ফলে পণ্যবাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহও কমে গেছে। সবমিলেই বাজারে বিদ্যমান ডলার সঙ্কট চলছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রফতানি আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর রফতানি আয় বাড়াতে হলে কমপক্ষে ১০-১২টি প্রধান পণ্য থাকা প্রয়োজন। এজন্য বিনিয়োগ নীতিমালায় যতটুকু জটিলতা আছে তা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নীতিসহায়তা দিয়ে বহুমুখী পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে হবে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বর্তমানে বাজারে ডলার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অত্যবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া অন্য তেমন কোনো পণ্যের আমদানিতে এলসি খোলা হচ্ছে না। আমদানি ঋণপত্র স্থাপনের হার অনেক কমে গেছে। কিন্তু এর ওপরে ডলার সঙ্কট মিটছে না। প্রতি নিয়তই কিছু কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য পরিমাণ ডলার সরবরাহ করছে। গত বৃহস্পতিবারও প্রায় ৬ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়। সবমিলে চলতি অর্থবছরের গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১২ বিলিয়নের ওপর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। আগে যেখানে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠে গিয়েছিল। রেমিট্যান্সও কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে পোশাক রফতানি কমে যাচ্ছে। কিন্তু আমদানি ব্যয় সামনে আর বেশি কমানো যাবে না। এতে ডলার সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এজন্য রফতানি আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।