কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
-৬৩ শতাংশ কাজ সমাপ্ত করতেই ১১ বছর শেষ
-৩ বছরের নির্মাণকাজ এখন এক যুগে উন্নীত
নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় লাগামহীন খরচ। আলোচিত কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প এক যুগেও শেষ হচ্ছে না। এখন অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্প সমাপ্ত করার নির্দেশ। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও সাড়ে ১১ বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ৬৩ শতাংশ। ফলে প্রতি বছর গড়ে কাজ হয়েছে মাত্র সোয়া ৫ শতাংশ। নানা অনিয়মের কারণে ২০১২ সালের শুরু হওয়া জনগুরুত্বপূর্ণ প্রই প্রকল্পটি ১১ বছর ধরে এখনো চলছে। ২৭৫ কোটি টাকা বাস্তবায়ন খরচ এখন ৬৮২ কোটি টাকায় উন্নীত। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্পটি নেয়ার কারণেই আজ এত অনিয়ম। এখন চলতি ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পকে বাধ্যতামূলক সমাপ্ত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঠিকাদার ও নির্বাহী প্রকৌশলী কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগ বলছে, প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো প্রয়োজন। চলতি ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব না। বিদেশ থেকে মালামাল আনতেও সময় লাগবে। তিনি জানান, দফায় দফায় বিভিন্ন কারণে সময় নষ্ট হয়েছে। যা আমরা ফিরে পাইনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনার তথ্যানুযায়ী, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পটি ২৭৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা ব্যয়ে একনেক থেকে অনুমোদন দেয়া হয় ২০১২ সালের ৬ মার্চ। প্রথমে এই প্রকল্পটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা ছিল। সেভাবেই একনেক থেকে অনুমোদন নেয়া হয়। কিন্তু এরপর দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয় ৯ বছর। প্রথমে সংশোধন করে ব্যয় বাড়ানো হয় এক লাফে ৬১১ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এরপর ৬৮২ কোটি ৪৬ লাখ ৬ হাজার টাকা। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ৯ বছরে এই প্রকল্পের গত ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতি হলো ৬০ শতাংশ। আর্থিক ব্যয় ২৪৫ কোটি ৫৮ লাথ ৯৩ হাজার টাকা বা ৪০.১৯ শতাংশ। এখন ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের বাস্তব অগ্রগতি হলো ৬৩ শতাংশ।
কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: জাহিদুল ইসলাম সময় বাড়ানোর প্রস্তাব গত এপ্রিলে প্রকল্প পরিচালককে দেন। সেখানে তিনি বলেন, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন (২য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের ২য় সংশোধনী প্রস্তাব ২০২১ সালের জানুয়ারিতে একনেকে উত্থাপিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন এবং সার্বিক প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর প্রকল্পের ২য় সংশোধনী প্রস্তাব ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। এটার প্রশাসনিক আদেশ এবং অর্থ বরাদ্দ না থাকায় ১ জানুয়ারি ২০২১ থেকে ১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত প্রায় ১১ মাস প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। তিনি বলেন, ২য় সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদনের পর সামগ্রিকভাবে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তবে প্রকল্পভুক্ত হাসপাতাল ভবন নির্মাণের একটি ভেরিয়েশন প্রস্তাব সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কর্তৃক অনুমোদনের প্রশাসনিক আদেশ গত ১৩ অক্টোবর ২০২০ জারি করা হয়। হাসপাতাল ভবন নির্মাণ কাজটির অনুমোদন ব্যতীত কোনো কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। বর্তমানে যে সময় আছে এই সময়ের মধ্যে হাসপাতাল ভবনের সব কাজ সমাপ্ত করে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব নয়।
গত এপ্রিলে লেখা গণপূর্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর চিঠিতে বলা হয়, প্রকল্পের জন্য নতুনভাবে অধিগৃহীত ৮ একর জমি অদ্যবধি হস্তান্তর করা হয়নি। ফলে সেখানে প্রস্তাবিত স্থাপনার নির্মাণকাজ আগামী জুন ২০২৩ এর মধ্যে সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া প্রকল্পভুক্ত বেশ কিছু কাজ যেমন- হাসপাতালের লিফট, এয়ারকুলার, মেডিক্যাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, সাবস্টেশনের যন্ত্রপাতি, মেডিক্যল গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার যন্ত্রপাতি ও মালামাল, অগ্নি নির্বাপণ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি প্রভৃতি বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এসব যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করে আগামী ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে কাজসমূহ সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ভৌত প্রকল্পের বর্তমান বাস্তবায়ন মেয়াদকাল জানুয়ারি ২০১২ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত নির্ধারিত। ফলে উপযুক্ত কারণ বিবেচনায় প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত কমপক্ষে ১ বছর বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
আর প্রকল্প পরিচালক বলছেন, এপ্রিল ২০২৩ তারিখের মধ্যে বৈদ্যুতিকসংযোগ, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পন্ন না হওয়ায় সীমিত আকারে হাসপাতাল ভবন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এপ্রিলের মধ্যে হাসপাতাল ভবন হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক বিল প্রকল্প থেকে নির্বাহ করা সম্ভব হবে না।
নির্বাহী প্রকৌশলী, কুষ্টিয়া জানান, বিভিন্ন কারণে ইলেট্রিক্যাল, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কাজ মার্চের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হয়নি।
প্রকল্প পরিচালক জানান, বর্তমানে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক না থাকায় হাসপাতালের জন্য জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। দ্রুত হাসপাতালের পরিচালক নিয়োগ করা প্রয়োজন।
এই প্রকল্পের ব্যাপারে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: জাহিদুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানান, বর্ধিত সময়ে যেটা চাওয়া হয়েছিল সেটা আর অনুমোদন দেবে না। এখন এটা আমাদের হাতে যত সময় আছে তার মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। তিনি বলেন, পিডি চিঠি দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ওনাদের এখনো দরপত্র কার্যক্রমই শেষ হয়নি।
তিন বছরের প্রকল্প প্রায় এক যুগ লেগে যাচ্ছে কারণ জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী মো: জাহিদুল ইসলাম বলেন, ২০১২ সালের মে মাসে প্রকল্পটি পাস হয়। কিন্তু লেখা আছে ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর। কিন্তু আমি বুঝি না এই পাঁচ মাসের সময়টা কিভাবে গণনা করা হবে। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হয়েছে ৮ মাস পর। ২০১২ সালের আগস্টে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের জমি বুঝিয়ে দেয়া হয়। এখানে প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছরের মধ্যে এভাবেই দুই বছর চলে যায়। তবে প্রকল্প যখন শুরু করা হয় তখন যদি যত্নসহকারে এবং গোছানো পরিকল্পনা নিয়ে করা হতো তাহলে আরো ভালো হতো। আর প্রকল্পে কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও ছিল না। কিন্তু পরে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি পরে করা যায় না, সমীক্ষা করা যায়।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের জুলাই মানে এসে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হরো। এই দেড় বছর কাজ করা গেল না। এরপর আবার করোনা আসল। ২০২০ সালের পরে আবার ২০২১ সালের পুরোটা সময়ই বিভিন্ন কারণে কাজ করা যায়নি। প্রকল্প অনুমোদন, অর্থছাড় ইত্যাদি। আমাকে কিন্তু ওই যে এগারোটা মাস চলে গেলে সেটা কিন্তু দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সমস্যাগুলো শুধু উপরে জানাতে পারি। আর সেটা জানিয়েওছি। নতুনভাবে বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে এখানে কাজ বাস্তবায়নের সুযোগ আছে। তিনি বলেন, ডরমিটরি ভবনও আমরা হস্তান্তর করেছি। হোস্টেলগুলোতে ছেলেমেয়রা থাকছেও।