লবণে অত্যাবশ্যকীয় আয়োডিন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শিশুদের বুদ্ধি বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অনেক বড় বড় কোম্পানির লবণে আয়োডিন পাওয়া যায় না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর প্রায়ই বাজারে হানা দিয়ে পরীক্ষা করে লবণে আয়োডিন পাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার লবণে আয়োডিন মেশানো বাধ্যতামূলক করে আইন করেছে, তা সত্ত্বেও লবণ কোম্পানিগুলো তা মানছে না। বর্তমানে প্রায় সব কোম্পানির এক কেজি লবণ ৪০ টাকায় বিক্রি করছে।
আয়োডিন বাংলাদেশের মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আয়োডিনের অভাবে গলায় গলগণ্ড বা ঘেগ হতো একসময়। এখন অবশ্য সেই ঘেগ রোগ থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসকরা বলেছেন, ব্রেন ও স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আয়োডিন প্রয়োজন। শরীরের জন্য মহাউপকারী থায়রয়েড হরমোনের একটি অপরিহার্য উপাদান আয়োডিন। থায়রয়েড হরমোন শরীরে বিপাকসংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এবং শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। থায়রয়েড হরমোন ব্রেন, মাংসপেশি, হৃৎপিণ্ড ও কিডনি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে সুস্থ ও সবল রাখে। চিকিৎসকরা বলছেন, আয়োডিনের অভাবে শরীরে পর্যাপ্ত থায়রয়েড হরমোন তৈরি না হলে হাইপোথায়রয়েডিজমে ভোগে মানুষ। হাইপোথায়রয়েডিজম হলে শরীরে আলসেমির ভাব আসে, ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না, অনিদ্রা দেখা দিতে পারে ও ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। এ ছাড়া আয়োডিনের অভাবে বিকলাঙ্গতাও দেখা দিতে পারে, গর্ভবতীদের গর্ভ নষ্টের ঝুঁকি বাড়ে।
১৯৮৯ সালে আয়োডিন স্বল্পতায় রোগ নিবারণ আইন পাস করে। ১৯৯৩ সালে এক সমীক্ষায় বাংলাদেশে ৪৭.১ শতাংশ মানুষের গলগণ্ডের রোগ রয়েছে জানার পর ১৯৯৪ সালে আয়োডিনহীন লবণ বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, মানুষের বুদ্ধি ও শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায় আয়োডিনের অভাবে।
লবণে আয়োডিন পরীক্ষা ঘরে বসেই করা যায়, এ জন্য কোনো মেশিনের প্রয়োজন নেই। অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, কোনো লবণে আয়োডিন আছে কি না, তা লেবুর রস দিয়ে পরীক্ষা করা যায়। লবণের মধ্যে লেবুর রস ফেললে যদি সে লবণ কিছুক্ষণ পর নীল রঙ ধারণ করে তা হলে বুঝতে হবে সেই লবণে আয়োডিন আছে। না থাকলে আয়োডিন নেই ধরতে হবে। লেবুর রস ঢালার পর লবণ যত বেশি নীল রঙ ধারণ করবে বুঝতে হবে সে লবণে যথাযথ পরিমাণে আয়োডিন আছে। লবণের রঙ হালকা নীল হলে বুঝতে হবে সে লবণে আয়োডিনের পরিমাণ কম।
কী থাকে লেবুর রসে? কেমিস্ট ড. শামসুল হক জানান, লেবুতে সাইট্রিক এসিড নামে একধরনের জৈব এসিড থাকে। আয়োডিনহীন খাবার লবণের সোডিয়াম ক্লোরাইড সাইট্রিক এসিডের সাথে কোনো বিক্রিয়া করে না। কিন্তু আয়োডিনের সাথে বিক্রিয়া করে আয়োডিনমুক্ত করে দেয় বলে আয়োডিনযুক্ত লবণ নীল হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযানে দেশের ছোট-বড় বেশ কিছু কোম্পানির লবণ পরীক্ষা করে লবণে আয়োডিন পাচ্ছে না বলে জানাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও লবণ কোম্পানিগুলো আয়োডিন ছাড়াই লবণ বিক্রি করছে উচ্চ দামে।
গত বৃহস্পতিবার রামপুরা এলাকার গৃহিণী শারমিন হক জানিয়েছেন, তিনি বাজার থেকে লবণ আনলেই লেবু দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে সেই লেবু পরীক্ষায় কোনো কোম্পানির লবণ নীল হচ্ছে না। তার মানে সেসব কোম্পানির লবণে আয়োডিন দেয়া হচ্ছে না। তিনি জানান, আয়োডিন শিশুদের বুদ্ধি বিকাশে সহায়তা করে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এ অবস্থায় আয়োডিনহীন লবণ দীর্ঘ দিন খেয়ে গেলে শিশুরা মেধাহীন হয়ে বড় হবে।
লবণে কেন আয়োডিন মেশাতে হয়? এই প্রশ্নের জবাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপরিতলের মাটিতেই আয়োডিন থাকে। ফল ও নানা ফসলের মাধ্যমে মাটি থেকে আয়োডিন পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি বছরই বন্যা হয়ে থাকে। ফলে মাটির উপরিতলের আয়োডিন পানিতে ধুয়ে চলে যায়। সে কারণে বাংলাদেশের মানুষ ফল ও ফসল থেকে আয়োডিন পায় না। ফলে লবণে আয়োডিন মিশিয়ে দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু লবণে কোম্পানিগুলো আয়োডিন দিচ্ছে না তা শুনে আমি মর্মাহত হয়েছি। সরকারের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা।