টালমাটাল পেঁয়াজের বাজার। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানেই নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম বেড়ে এখন ৮০ টাকার ঘরে। বাজারে কৃত্রিম সংকট ও কারসাজি করে কয়েক দফায় বাড়িয়ে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে পেঁয়াজের দাম। আর এমন কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে অন্তত ৩০ অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। সিন্ডিকেটের এই তালিকায় থাকা ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, আড়তদার ও ব্যাপারীদের একটি অংশ খাতুনগঞ্জ বাজারের ও আরেকটি অংশ দেশে পেঁয়াজের উৎপত্তিস্থলের অসাধুদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে প্রশাসন। তাদের সবাই মধ্যস্বত্বভোগী। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কম দামে পেঁয়াজ কিনে বেশি দাম নির্ধারণ করে দেয়। মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে তারা দু’দিক থেকেই আদায় করে বাড়তি মুনাফা। আর পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করে সুবিধাভোগী এসব মধ্যস্বত্বভোগী অসাধুর পেটে ভোক্তার শতকোটি টাকা ঢুকে গেছে বলে জানিয়েছেন ক্যাবসহ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা।
কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকা উল্লেখযোগ্যরা রয়েছেন– খাতুনগঞ্জের মেসার্স মোহাম্মদীয়া বাণিজ্যালয়ের হাজি মোজাম্মেল হক, শাহ জালাল বাণিজ্যালয়ের মো. ইকবাল, বরকত বাণিজ্যালয়ের আবু তৈয়ব, শাহ আমানতের মো. সেলিম, মেহের ট্রেডার্সের মো. আলী, মেসার্স আজগর সওদাগরের মো. আজগর, খাতুনগঞ্জ ট্রেডিং, আব্দুল মান্নান, একতা ট্রেডার্স, শাহ মোহছেন আউলিয়া, বার আউলিয়া ট্রেডার্স, আল্লার দান স্টোরের মো. জাহাঙ্গীর, এফ আর ট্রেডার্সের মো. জাকির হোসেন, এস এম ট্রেডার্সের মো. বাবুল এবং নিউ শাহ আমানত ট্রেডার্সের হাজি আবু তৈয়ব। এ-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ সমকালের কাছে সংরক্ষণে রয়েছে। ফড়িয়াদের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসন। তাদের মতে, পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করার পেছনে কোনো না কোনোভাবে জড়িত তারা। শুধু কয়েকগুণ বেশি ‘বাড়তি’ মুনাফা হাতিয়ে নিতেই কিছুদিন পর পর দফায় দফায় বাজারে সংকট দেখিয়ে কারসাজি করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে তারা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সমকালকে বলেন, পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার পেছনে অনেকের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি আমরা। বিষয়টি উদ্বেগের। কারসাজির সঙ্গে আর কে বা কারা জড়িত, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জড়িতদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে। ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ে যাতে কেউ কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।
জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. উমর ফারুক বলেন, পেঁয়াজের বাজারে কারসাজির মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিতরা দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধির পেছনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের বেশিরভাগই মধ্যস্বত্বভোগী। খাতুনগঞ্জসহ দেশের বড় বাজারগুলোতে তাদের কিছু লোক রয়েছে, যাদের মাধ্যমে বাজারে বাড়তি দাম নির্ধারণ করে পরে ধাপে ধাপে পেঁয়াজভর্তি ট্রাক প্রবেশ করায় তারা। নানা কৌশল অবলম্বন করে কয়েক হাত বদল করে এক পর্যায়ে ৩০ টাকায় কেনা পণ্যের দাম ৮০ টাকায় নিয়ে যায় তারা। এভাবে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা করে কিছুদিনেই শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা।
কারসাজিতে জড়িত থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের নিউ শাহ আমানত ট্রেডার্সের মালিক আবু তৈয়ব বলেন, কমিশনের ভিত্তিতে আমরা পেঁয়াজ বিক্রি করি। কারসাজির সঙ্গে আমার জড়িত থাকার তথ্য সঠিক নয়। কারসাজি করলে দেশে পেঁয়াজের উৎপত্তিস্থলের ব্যাপারী, আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা করছেন।
সরবরাহ সংকটের কারণেই পেঁয়াজের দাম এত বেশি বেড়ে গেছে বলে দাবি করেন আল্লার দান স্টোরের মো. জাহাঙ্গীর। জড়িত থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। ব্যাপারীরা আমাদের যে দাম বেঁধে দেন, সেই দামেই আমরা খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজ বিক্রি করি। দেশে পেঁয়াজের উৎপত্তিস্থলে দাম বেড়ে গেলেই এখানেও দাম বেড়ে যায়।
টিসিবির তথ্য মতে, এক মাসের ব্যবধানে দেশে দেশি পেঁয়াজের দাম সর্বোচ্চ ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। আর গত বছরের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম প্রায় ৭২ শতাংশ বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১০ লাখ টনেরও বেশি। এ বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। আর মজুত আছে প্রায় ১৮ লাখ টন। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা কারসাজি করেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছে খোদ বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়।
সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়ে গেছে স্বীকার করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বেশি মুনাফা লাভের আশায় অনেকে পেঁয়াজ মজুত রেখে সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। যে কারণে ভোক্তা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়ে গেছে। পেঁয়াজের বাজার নিয়ে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমদানি ছাড়া কোনো উপায় নেই।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পেঁয়াজের যথেষ্ট মজুত থাকার পরও এত দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যাবতীয় বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
এদিকে, কয়েক দিন ধরে শিগগিরই পেঁয়াজের আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে বলে আসছেন মন্ত্রীরা। এ খবরে বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জের মোকামে প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারিতে মানভেদে ৬৫ থেকে ৭২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে এখনও প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। খাতুনগঞ্জের কাঁচাপণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান কাজী স্টোরের স্বত্বাধিকারী জাবেদ ইকবাল সমকালকে বলেন, আমদানি শুরু হচ্ছে– এই খবরে দাম কমানো হচ্ছে। তবে শিগগির আমদানি শুরু না হলে দাম আবারও বেড়ে যাবে। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, কয়েক দফায় পেঁয়াজের দাম কয়েকগুণ বাড়তে থাকায় আমরা প্রশাসনের প্রতি বাজার তদারকি বাড়াতে আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তারা সেটি করেনি। অথচ এখন ঠিকই কারসাজির প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু এই লম্বা সময়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে ভোক্তাদের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর দায় প্রশাসন এড়াতে পারে না।