‘১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না; এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না’ (আহমদ ছফা)।
অনেকদিন আগে প্রখ্যাত লেখক-দার্শনিক আহমদ ছফার এই বক্তব্য বাংলাদেশের পরতে পরতে এখন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। বর্তমানে দেশের বুদ্ধিজীবী-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যা বলছেন, তা শুনলে দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, জনগণের ভোটের অধিকার কোনোদিন নিশ্চিত হবে না। তাদের তোষামোদী, চাটুকারিতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈহৈ রৈরৈ পড়ে গেছে।
ফ্রান্সে যাদের ‘আঁতেল’ বলা হয় এই উপমহাদেশে তাদের বলা হয়ে থাকে ‘বুদ্ধিজীবী’। এরা শিক্ষকতা, লেখালেখি, সাংবাদিকতাসহ নানা পেশায় বুদ্ধিবিক্রি করে খান। এ নিয়ে আহমদ ছফার প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা ‘উচ্চ শিক্ষিত’ গণবিচ্ছিন্ন এই বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীকে তিনি হাড়ে হাড়ে চিনেছিলেন। সে জন্যই হয়তো তিনি ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রবন্ধ, ‘মুসলমানের মন’ নিবন্ধ বা ‘গাভি বৃত্তান্ত’ উপন্যাস লিখেছিলেন।
‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক দু’দিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছেন। তিনি জনগণের ভোটের অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর প্রস্তাব করেছেন। আর এই তিনি হলেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন। ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ঢাবি শিক্ষক সমিতি আয়োজিত এক ‘প্রতিবাদ মানববন্ধন’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বুদ্ধি দিয়ে বলেছেন, ‘দৈব-দুর্বিপাক দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সংসদের (একাদশ) মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি করতে পারেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দেয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে আমি মনে করি, এই সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কোনো দরকার নাই। করোনার দুর্যোগের কারণে এ সরকার দুই বছর ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি। তাই মহাদুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনায় এই সংসদের মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি করা যেতে পারে। অন্তত দুই বছর মেয়াদ তো বৃদ্ধি করাই যায়। বর্তমান দেশে ‘হানাহানির’ রাজনৈতিক পরিবেশে সরকারের নির্বাচন দেওয়ার কোনো বাধাবাধ্যকতা নেই’। তিনি প্রস্তাবটি বাস্তাবায়নে সরকার, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনিক সব পক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে তিনি আহ্বান জানান। ওই প্রতিবাদ মানববন্ধন অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নীল দল’ হিসেবে পরিচিত কয়েকশ শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে যারা বক্তব্য দিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই একটি দলকে তোষামোদী করে বক্তব্য দেন।
অধ্যাপক জামালউদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রাম, ইউটিউবে ‘প্রতিবাদ বক্তব্য’ ছয়লাব হয়ে গেছে। নেটিজেনরা নিজেদের মতো করে তাকে নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, মন্তব্য-আক্রমন করছেন। যার বেশির ভাগ শব্দ আপত্তিজনক। যেমন ‘দালাল, শিক্ষিত মূর্খ, চাটুকার, জোচ্চোর, তোষামুদে, আহাম্মক, উচ্ছিষ্টভোগী, আগামীর ভিসি পদ প্রত্যাশি ইত্যাদি হাজারো আপত্তিকর শব্দ আমাদের সন্মানিত শিক্ষক অধ্যাপক জামালউদ্দিন নামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে এরাই আমাদের শিক্ষাগুরু, আগামীর মানুষ বানানোর কারিগর। প্রশ্ন হচ্ছে এই চিন্তা চেতনার শিক্ষকরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কি শিক্ষা দিচ্ছেন-দেবেন? এদের কাছে শিক্ষা নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা কর্মজীবনে জাতির কি উপকার করবে? যারা কিছু উচ্ছিষ্ট পাওয়ার লোভে ‘বিবেক বন্ধক’ রাখেন, তাদের কাছে দেশ জাতি কি প্রত্যাশা করতে পারে? এর আগে আরেকজন অধ্যাপক জাফর ইকবাল অন্যের লেখা চুরি করে নিজের নামে ‘টেক্সস বুক বোডের বই’ লিখে ধরা খেয়েছেন। পরে নিজে চৌর্যবৃত্তির কথা স্বীকার করে মাফ চেয়েছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা, নতুন নতুন গবেষণা, আবিস্কার হওয়ার কথা; ষেখানে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে চৌর্জবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে এবং তা প্রমাণ হয়েছে। অন্যের লেখা চুরি করে নিজের ‘গবেষণা’ হিসেবে চালিয়ে দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রী বাগিয়ে নিয়েছেন, চাকরি করে খাচ্ছেন।
অপ্রিয় হলে সত্য যে, এখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক জামালউদ্দিনদের মতো শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। এরা শিক্ষাকে ব্রত হিসেনে না নিয়ে কেউ ‘সাদা দল’ কেউ ‘নীল দল’ কেউ ‘গোলাপী দল’ করে নিজেদের রাজনৈতিক দলের অন্ধকর্মীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এদের কাছে ভালমন্দ-ন্যায়-অন্যায়-মানবিকতা- আইনের শাসন, অবিচার-বিচার, সত্য-মিথ্যা সবকিছু তুচ্ছ। রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা যেটা বলবেন তারা ‘শিক্ষিত বিবেক’ ঘুমিয়ে রেখে তাতেই সমর্থন করেন।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। ৩০ লাখ রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এদেশ চীন, রাশিয়া বা সউদী আরবের মতো দেশ নয়। সউদী আরব, চীন বা রাশিয়ায় জনগণ ভোট দিতে পারলেন কি পারলেন না সেটা বিবেচ্য নয়। কারণ ওই সব দেশে গণতন্ত্র নেই তথাকথিত সমাজতন্ত্র বা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় সংবিধানে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে জনগণকে বোকা বানিয়ে নির্বাচনী তামাশা করা হয়েছে। এখন জনগণ ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বিশ্বের উন্নয়ন সহযোগী ও প্রভাবশালী দেশগুলো চায় বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা হোক। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া সব দেশ বর্তমান সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে। গতকালও জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফান দুজারিক বলেছেন, ‘আমাদের বার্তা স্পষ্ট, বাংলাদেশে আমরা একটি বিশ্বাসযোগ্য, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চাই।’ এর আগে গত ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে ওয়াশিংটন ডিসিতে ডেকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশের সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এই নির্বাচন যেন সারাবিশ্বের কাছে মডেল নির্বাচন হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্ব বাংলাদেশে মডেল নির্বাচন দেখার জন্য তাকিয়ে রয়েছে’। ঢাকায় দায়িত্বপালনকরা জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো রাতে নির্বাচন হয় এমন কথা পৃথিবীর কোথাও শুনিনি’। বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য দেশ-বিদেশ তোলপাড় চলছে; ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে ‘যুদ্ধাবস্থা’ বিরাজ করছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে লাখের বেশি মামলা হয়েছে, জাতিসংঘসহ বিদেশী শক্তিগুলো ঘন ঘন ঢাকা সফর করে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন। সরকার বাধ্য হয়েই এবার নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘কূটনীতিক বন্ধুদের আশ্বস্থ্য করছি বাংলাদেশে এবার ‘ঐতিহাসিন নির্বাচন’ করা হবে। জনগণের ভোটের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন নিয়ে এতো কিছু হচ্ছে, সেগুলো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকদের স্পর্শ করছে না! উটপাখির বালুতে মুখ লুকিয়ে রাখার মতো এই উচ্ছিষ্টভোগী শিক্ষকরা নিজেদের বিবেক গর্তে লুকিয়ে রেখে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘তোষামোদ’ কবিতার মোসাহেবের মতো ‘হুজুরের মতে অমত কার’ গাইতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। নীতি-নৈতিকতা লাজ লজ্জা হারিয়ে সরকারকে কুমন্ত্রণা দিচ্ছেন।
এমনিতেই গুম-মানবাধিকার লংঘন, বিনা বিচারে হত্যার কারণে আন্তর্জাতিক মহল বিক্ষুব্ধ। ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো পাতানো ভোট হওয়ার সুযোগ নেই। সে ধরনের নির্বাচন হলে বাংলাদেশের ওপর থেকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো মুখ ফিরিয়ে নেবে। ফলে দেশের প্রয়োজনে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার প্রয়োজনে সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন তথা জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। দেশের জ্ঞানতাপস হিসেবে বিবেচিত অধ্যাপক জামালউদ্দিনের মতো ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী দলবাজ শিক্ষকরা এসব কর্ণপাত করছেন না। তারা ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীদের নামে হুক্কাহুয়া দিয়েই যাচ্ছেন। লেখক আহমদ ছফা হয়তো অধ্যাপক জামালউদ্দিন, অধ্যাপক জাফর ইকবালদের মতো শিক্ষাবিদদের (!) চরিত্র আগেই ধরে ফেলেছেন। তাইতো যথার্থভাবে বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র উন্মোচন করে গেছেন। ##