রামাদান মাস সিয়াম সাধনা ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফযীলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন। এ গুরুত্ববহ তাৎপর্যময় মাস সারা বিশ্বের মুসলমানদের সুদীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুুত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়। মুমিন বান্দার জীবনে বছরের মধ্যে রমজান মাসটিই এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়। তাই এ পুণ্যময় মাসের গুরুত্ব এত বেশি। এ কারণেই বলা হয়, পবিত্র রমজান মাস হচ্ছে ইবাদত, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, জিকর, শোকর ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বিশেষ মৌসুম।
একদা নবী করিম (সা.) মাহে রমজানের প্রাক্কালে বলেন, ‘রমজান মাস আগতপ্রায়, এ মাস বড়ই বরকতের মাস, আল্লাহ তাআলা বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন এবং খাছ রহমত বর্ষণ করেন, গুনাহ মাফ করেন ও দোয়া কবুল করেন।’ রোজাদারের মর্যাদা উল্লেখ করে হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘রোজাদারের নিদ্রা ইবাদতের সমতুল্য, তার চুপ থাকা তসবিহ পাঠের সমতুল্য, সে সামান্য ইবাদতে অন্য সময় অপেক্ষা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হয়। ঈমান ও এহতেসাবের সঙ্গে যে ব্যক্তি রোজা রাখে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ আর রোজাদারের মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষ যত প্রকার নেক কাজ করে আমি তার সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ বৃদ্ধি করে দিই। কিন্তু রোজা এই নিয়মের বাইরে। রোজার সওয়াব একই নিয়মে সীমাবদ্ধ বা সীমিত নয়। রোজার সওয়াবের পুরস্কার স্বয়ং আমি প্রদান করব। অথবা আমি নিজেই রোজার সওয়াবের পুরস্কার।’ এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে উল্লেখ হয়েছে, যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো নফল কাজ করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজই আদায় করল। আর যে এ মাসে কোনো ফরজ আদায় করল সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করল। নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যারা রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করেছে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে প্রসব করেছিলেন।’
রামাদান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজই হল সিয়াম। আর সিয়াম হল ফজরের উদয়লগ্ন থেকে সূর্যাস্তু পর্যন্ত নিয়্যাত সহ পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা। রামাদান মাসের রোজাকে ফরজ করে যে আয়াত নাযিল হয় তাতে আল্লাহ্ রোজার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নির্দেশ করেছেন :
সিয়াম পালন তথা রোযা ফরয এবং এটি ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَاٱلَّذِينَءَامَنُواْكُتِبَعَلَيۡكُمُٱلصِّيَامُكَمَاكُتِبَعَلَىٱلَّذِينَمِنقَبۡلِكُمۡلَعَلَّكُمۡتَتَّقُونَ١٨٣
﴾‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমদের উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।(সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৩)
﴿فَمَنشَهِدَمِنكُمُٱلشَّهۡرَفَلۡيَصُمۡهُۖ
﴾‘‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোযা পালন করে।’’ (সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৫)
রোযার গুরুত্ব আরো প্রকটিত হয় সে সব ফযীলতের দ্বারা, যদ্বারা একে বিশেষত্ব দান করা হয়েছে। সে সবের মধ্যে রয়েছেঃ
১ রমজান হল কোরআন নাজিলের মাস : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন:
রমজান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কোরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। (সূরা বাকারা : ১৮৫)রমজান মাসে সপ্তম আকাশের লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল-কোরআন একবারে নাজিল হয়েছে। সেখান হতে আবার রমজান মাসে অল্প অল্প করে নবী করিম স.-এর প্রতি নাজিল হতে শুরু করে। এ মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাজিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কোরআন তিলাওয়াত করা উচিত। প্রতি বছর রমজান মাসে জিবরাইল রাসূলুল্লাহ স.-কে পূর্ণ কোরআন শোনাতেন এবং রাসূল স.-ও তাকে পূর্ণ কোরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমজানে আল্লাহর রাসূল দু বার পূর্ণ কোরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহি মুসলিমের হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত।
২.এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
, إِذَاجَاءَرَمَضَانُفُتِّحَتْأَبْوَابُالْجَنَّةِوَغُلِّقَتْأَبْوَابُالنَّارِوَصُفِّدَتِالشَّيَاطِينُগ্ধ
‘‘রামাদান মাসে এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃংখলিত করা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০০)
৩.এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদেরর ন্যায় বরকতময় রজনীঃমহান আল্লাহ বলেন,
﴿لَيۡلَةُٱلۡقَدۡرِخَيۡرٞمِّنۡأَلۡفِشَهۡرٖ٣تَنَزَّلُٱلۡمَلَٰٓئِكَةُوَٱلرُّوحُفِيهَابِإِذۡنِرَبِّهِممِّنكُلِّأَمۡرٖ٤سَلَٰمٌهِيَحَتَّىٰمَطۡلَعِٱلۡفَجۡر٥﴾ِ
‘‘লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত’’ (সূরা আল-ক্বদরঃ ৩-৫)
৪.এ মাস দো‘আ কবুলের মাসঃনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّلِلَّهِعُتَقَاءَفِيكُلِّيَوْمٍوَلَيْلَةٍلِكُلِّعَبْدٍمِنْهُمْدَعْوَةٌمُسْتَجَابَةগ্ধ
‘‘(রামাদানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দো‘আ কবুল হয়ে থাকে (যা সে রামাদান মাসে করে থাকে)।’’ (সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কতৃক বর্ণিত, হাদীস নং ৭৪৫০)
৫.রোযার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেনঃএকটি হাদীসে কুদসীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
كُلُّعَمَلِابْنِآدَمَلَهُإِلَّاالصِّيَامَفَإِنَّهُلِيوَأَنَاأَجْزِيبِهِগ্ধ
আল্লাহ বলেন, ‘‘বনী আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দিব।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫)
৬.রোযা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণঃরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْصَامَرَمَضَانَإِيمَانًاوَاحْتِسَابًاغُفِرَلَهُمَاتَقَدَّمَمِنْذَنْبِهগ্ধ
‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১০)
৭.রোযা জান্নাত লাভের পথঃরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّفِىالْجَنَّةِبَابًايُقَالُلَهُالرَّيَّانُيَدْخُلُمِنْهُالصَّائِمُونَيَوْمَالْقِيَامَةِلاَيَدْخُلُمَعَهُمْأَحَدٌغَيْرُهُمْيُقَالُأَيْنَالصَّائِمُونَفَيَدْخُلُونَمِنْهُفَإِذَادَخَلَآخِرُهُمْأُغْلِقَفَلَمْيَدْخُلْمِنْهُأَحَدٌগ্ধ
‘‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’ – কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না….. রোযাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৭)
৮. সিয়াম রোযাদারের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবেঃরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন:
قالصلىاللهعليهوسلم: الصياموالقرآنيشفعانللعبديومالقيامةيقولالصيامأيربإنيمنعتهالطعاموالشهواتبالنهارفشفعنيفيهيقولالقرآنربمنعتهالنومبالليلفشفعنيفيهفيشفعان. قالالشيخالألباني: صحيح،انظرحديثرقم: ৩৮৮২ فيصحيحالجامع
“কিয়ামতের দিন রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, ‘হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেয়নি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহন করুন। ফলে এ দু’য়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।” ’’ (মুসনাদ, হাদীস নং ৬৬২৬)
৯.রোযা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢালঃরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ
مامنعبديصوميومافيسبيلاللهابتغاءوجهاللهإلاباعداللهعنوجههوبينالنارسبعينخريفا.
যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর রাস্তুায় একদিন রোযা রাখে আল্লাহ তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে ৭০ বছরের দূরত্ব তৈরী করেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৪)
১০. এ মাসের রোযা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোযা রাখার সমানঃরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন
صيامشهررمضانبعشرةأشهروصيامستةأيامبشهرينفذلكصيامالسنة
রামাদানের রোযা দশ মাসের রোযার সমতূল্য, ছয় রোযা দু’মাসের রোযার সমান, এ যেন সারা বছরের রোযা।
১১. রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তমঃরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَالَّذِىنَفْسُمُحَمَّدٍبِيَدِهِلَخُلُوفُفَمِالصَّائِمِأَطْيَبُعِنْدَاللَّهِيَوْمَالْقِيَامَةِمِنْرِيحِالْمِسْكِগ্ধ
‘‘যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! রোযাদারের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৪)
১২.রোযা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তিলাভের উপায়ঃরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لِلصَّائِمِفَرْحَتَانِفَرْحَةٌعِنْدَفِطْرِهِوَفَرْحَةٌعِنْدَلِقَاءِرَبِّهগ্ধ
‘‘রোযাদারের জন্য দু’টো খুশীর সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫)
রোযার আরো ফযীলতের মধ্যে রয়েছে – এতে ইচ্ছা ও সংকল্পে দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়, চারিত্রিক মাহত্ম্য অর্জিত হয়, শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তিলাভ করা যায় এবং সর্বোপরি তা মুসলিম উম্মাহ্ একতাবদ্ধ হওয়ার এক বাস্তুব নিদর্শন।
এক. রোযাদারকে ইফতার করানোঃসহীহ সনদে তিরমিযী ও আহমাদ বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْفَطَّرَصَائِمًاكُتِبَلَهُمِثْلُأَجْرِهِإِلَّاأَنَّهُلَايَنْقُصُمِنْأَجْرِالصَّائِمِشَيْءগ্ধ
‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, সে উক্ত রোযাদারের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটিত না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’’ (সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৭)
দুই. এ মাস সবর বা সহিষ্ণুতার মাসঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন:
وعنابنعباسرضياللهعنهماقال: قالرسولاللهصلىاللهعليهوسلم: صومشهرالصبروثلاثةأياممنكلشهريذهبنوحرالصدر. رواهالبزارورجالهرجالالصحيح،قالالشيخالألباني: حسنصحيح .
ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত এ হাদীসে রামাদান মাসকে সবরের মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ “সবরের মাসে রোযা রাখা ও প্রত্যেক মাসে তিনদিন রোযা রাখা অন্তরের অস্থিরতা দূর করে থাকে।” (আলবানী বলেন হাসান-সহীহ হাদীস নং ১৭০৩৩)
তিন. কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা
রামাদান মাস কুরআন নাযিলের মাস। এ মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীলের সাথে কুরআন পাঠ করতেন। তার সীরাত অনুসরণ করে প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এ মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা, বুঝা এবং আমল করা। ইবনু আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
كَانَجِبْرِيلُيَلْقَاهُفِيكُلِّلَيْلَةٍمِنْرَمَضَانَفَيُدَارِسُهُالْقُرْآنَগ্ধ
“জিবরীল রামাদানের প্রতি রাতে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাকে নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০৪৮)
চার. আল্লাহর রাস্তুায় বেশী বেশী দান ও সদকা করা
আল্লাহর রাস্তুায় দান-সদকা ও ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। সব সময় যাতে সামর্থবান ব্যক্তিবর্গ এ ইবাদাত পালন করে সে ব্যাপারে ইসলাম ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছে। আর রামাদান মাসে এ ইবাদাতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কেননা ইমাম বুখারী ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন যে,
كَانَرَسُولُاللَّهِصَلَّىاللَّهُعَلَيْهِوَسَلَّمَأَجْوَدَالنَّاسِوَكَانَأَجْوَدُمَايَكُونُفِيرَمَضَانَحِينَيَلْقَاهُجِبْرِيلُ…….فَلَرَسُولُاللَّهِصَلَّىاللَّهُعَلَيْهِوَسَلَّمَحِينَيَلْقَاهُجِبْرِيلُأَجْوَدُبِالْخَيْرِمِنْالرِّيحِالْمُرْسَلَةِ
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল মানুষের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। আর রামাদান মাসে যখন জিবরীল তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি আরো দানশীল হয়ে উঠতেন…..। জিবরীলের সাক্ষাতে তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০৪৮)
পাচ. বেশী বেশী দো‘আ, যিকর এবং ইস্তেুগফার করাঃ
রামাদানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফযীলতময়। তাই সকলের উচিত এ বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা- দো‘আ, যিকর ও ইসস্তেুগফারের মাধ্যমে। কেননা রামাদান মাস দো‘আ কবুল হওয়ার খুবই উপযোগী সময়, যেমন প্রবন্ধের শুরুতে একটি হাদীসের বর্ণনায় বলা হয়েছে।
ছয়. সকল প্রকার ইবাদতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখাঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদান মাসে অন্য মাসের চেয়েও বেশী বেশী ইবাদাত করতেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়েম (রহ.) বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল রামাদান মাসে সকল ধরনের ইবাদাত বেশী বেশী করা। তিনি ছিলেন সবচেয়ে দানশীল এবং রামাদানে আরো বেশী দানশীল হয়ে যেতেন, কেননা এ সময়ে তিনি সদকা, ইহসান ও কুরআন তেলাওয়াত, নামায, যিকর ও ইতেকাফ ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদাত অধিক পরিমাণে করতেন। তিনি রামাদানে এমন বিশেষ ইবাদাত সমূহ পালন করতেন যা অন্য মাসগুলোতে করতেন না। (যাদুল মাআ‘দ ১/৩২১)
সাত. কিয়ামু রামাদান বা রামাদানের তারাবীহের ফযিলতঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন:
عنأبيهريرةأنرسولاللهصلىاللهعليهوسلمقال: منقامرمضانإيماناواحتساباغفرلهماتقدممنذنبه . قالالشيخالألباني : صحيح
যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রামাদানের তারাবীহ আদায় করল তার পূর্বের সমস্তু গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য এক হাদীসে এভাবে ইরশাদ করেছেন:
فقالإنالرجلإذاصلىمعالإمامحتىينصرفحسبلهقيامليلة. قالالشيخالألباني: الحديثصحيحانظر: صحيحسننأبيداودযখন কোন ব্যক্তি ইমামের সাথে ইমাম তার নামায শেষ করা পর্যন্তনামায আদায় করবে তার জন্য তা সারা রাত জেগে ইবাদত করা হিসেবে গণ্য হবে।
আট. লাইলাতুল ক্বাদর এর বিশেষ ফযিলতঃ
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
قالتعالى: إِنَّاأَنْزَلْنَاهُفِيلَيْلَةِالْقَدْرِ. وَمَاأَدْرَاكَمَالَيْلَةُالْقَدْرِ. لَيْلَةُالْقَدْرِخَيْرٌمِنْأَلْفِشَهْرٍ. تَنَزَّلُالْمَلائِكَةُوَالرُّوحُفِيهَابِإِذْنِرَبِّهِمْمِنْكُلِّأَمْرٍ. سَلامٌهِيَحَتَّىمَطْلَعِالْفَجْرِ..
আমরা লাইলাতুল কাদরে তা (কুরআন) নাযিল করেছি, আপনি কি জানেনলাইলাতুল কাদর কি?লাইলাতুল কাদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, এতে ফিরেশতাকূল ও জিবরিল তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে সকল বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হয়, ফজর উদিত হওয়া পর্যন্তইহা শান্তিময়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ
قالصلىاللهعليهوسلم: منقامليلةالقدرإيماناواحتساباغفرلهماتقدممنذنبه.
যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে লাইলাতুল কাদর জেগে ইবাদত করল তার পূর্বের সমস্তু গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
শরীয়ত যা বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছে ঃ
শরীয়তের পক্ষ থেকে মূলত: ছোট-বড় সকল গোনাহ ও পাপ সর্বদা বর্জন করার নির্দেশ এসেছে। আর রামাদান মাস ফযীলতের মাস এবং আল্লাহর ইবাদাতের প্রশিক্ষণ লাভের মাস হওয়ায় এ মাসে সর্বপ্রকার গোনাহের কাজ পরিত্যাগ করা অধিক বাঞ্ছনীয়। তদুপরি রামাদান মাসে সৎকাজের সওয়াব ও নেকী বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, তাই রামাদানের সম্মান ও ফযীলতের কারণে এ মাসে সংঘটিত যে কোন পাপের শাস্তিু অন্য সময়ের তুলনায় ভয়াবহ হবে এটাই স্বাভাবিক।এজন্যেই রোযাদারদের উচিত তাকওয়া বিরোধী সকল প্রকার মিথ্যা কথা ও কাজ পরিপূর্ণভাবে বর্জন করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْلَمْيَدَعْقَوْلَالزُّورِوَالْعَمَلَبِهِفَلَيْسَلِلَّهِحَاجَةٌفِيأَنْيَدَعَطَعَامَهُوَشَرَابَهগ্ধ
‘‘যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করে না তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৪)অন্য আরেকটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَاكَانَيَوْمُصَوْمِأَحَدِكُمْفَلَايَرْفُثْوَلَايَصْخَبْفَإِنْسَابَّهُأَحَدٌأَوْقَاتَلَهُفَلْيَقُلْإِنِّيامْرُؤٌصَائِمগ্ধ
‘‘তোমাদের কেউ রোযার দিনে অশ্লীল কথা যেন না বলে এবং শোরগোল ও চেঁচামেচি না করে। কেউ তাকে গালমন্দ করলে বা তার সাথে ঝগড়া করলে শুধু বলবে, আমি রোযাদার ।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫)
যে ব্যক্তি কল্যাণকামী মাস মাহে রমযান পেয়ে নিজের গুনাহ মাফ করতে পারলো না, সে হল সবচেয়ে হতভাগ্য ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে হাদীসঃ হযরত কা’ব কর্তৃক হাদীসটি বর্ণিত। একদা রাসূল (সা.) মসজিদে ইরশাদ করলেন : ‘‘তোমরা মিম্বরের নিকটবর্তী হও। আমরা নিকটে গেলাম। হুযুর (সা.) মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, ‘আমীন’। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও দু’বার আমীন বললেন। খুতবা শেষে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে হযরত বললেন, এই মাত্র হযরত জিবরাঈল (আ.) তাশরীফ এনেছিলেন। প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তির ওপর লা’নত যে রমযান মাস পেয়েও নিজের পাপ মাফ করিয়ে নিতে পারেনি। আমি বললাম, ‘আমীন’ অর্থাৎ তাই হোক। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখতেই জিবরাঈল বললেন, লা’নত ঐ ব্যক্তির ওপর যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হওয়া সত্ত্বেও দরূদ পড়েনি। আমি বললাম, ‘আমীন’। অতপর তৃতীয় সিঁড়িতে আমি পা রাখতেই জিবরাঈল বললেন, লা’নত ঐ ব্যক্তির ওপর যার সামনে মাতা-পিতা উভয়ই অথবা দু’জনের একজন বার্ধক্যে পৌঁছেছে কিন্তু সে তাদের সেবাকর্মে নিজেকে জান্নাতের যোগ্য করতে পারলো না। উত্তরে আমি বললাম, ‘আমীন’।
শেষকথাঃ
ত্বাকওয়া অর্জনের এ মুবারক মাসে মুমিনদের উপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি হয়েছে পূণ্য অর্জনের বিশাল সুযোগ এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের উচিত চারিত্রিক অধ:পতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, নেতিয়ে পড়া চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সকল প্রকার অনাহুত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা, যাতে তারা রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কুরআন নাযিলের এ মাসে কুরআনের মর্ম অনুধাবন করতে পারে, তা থেকে হিদায়াত লাভ করতে পারে এবং জীবেনের সর্বক্ষেত্রে একেই অনুসরণের একমাত্র মত ও পথ রূপে গ্রহণ করতে পারে।
মাহে রমজানে রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করেন। রিপুর তাড়না থেকে তাকে মুক্ত করে তার ভেতর তাকওয়া-খোদাভীতি ও আল্লাহপ্রেম জাগ্রত করতে চান। সেই সত্য-সুন্দরের পথ তাকে সাফল্য ও মুক্তির দ্বারপ্রান্তেনিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসের রোজা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, সেহির, ইফতার, তারাবি নামাজ, সাদাকাতুল ফিতর, জাকাত, দান-খয়রাত প্রভৃতি আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতরাজি, যা রোজাদারদের কুপ্রবৃত্তি দমন ও তাকওয়া বা খোদাভীতিপূর্ণ ইবাদতের মানসিকতা সৃষ্টিতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগায়। পবিত্র মাহে রমযানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সর্বজনীন-কল্যাণের শাশ্বত চেতনায় সকল অকল্যাণ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবতাকে বিজয়ী করার পথে আমাদের এগিয়ে দিক। আল্লাহ আমাদের সকল আমল কবুল করুন এবং আমাদের সবাইকে আরো উত্তম আমল করার তাওফীক দান করুন।