ব্যয়বহুল ডায়াবেটিস চিকিৎসার ব্যয় আরো বেড়েছে। এ রোগের পরীক্ষা ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্ট্রিপ, ইনসুলিন এবং মুখে খাওয়া বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ায় রোগীপ্রতি মাসিক খরচ দুই থেকে চার হাজার টাকা বেড়েছে। এসব খরচ পুরোটাই রোগীকে বহন করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ পরিবারের ডায়াবেটিক রোগীর চিকিৎসা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।
ওষুধ বিক্রেতারা বলছেন, গত এক বছরে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে ওষুধের দাম।
গতকাল সোমবার ঢাকার শাহবাগে বারডেম হাসপাতালে গিয়ে দেখা মেলে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের বাসিন্দা মাবিয়া বেগমের। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। আগে গড়ে তাঁর মাসিক খরচ দুই হাজার টাকা হলেও ওষুধের দাম বাড়ায় এখন প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।
হতাশা প্রকাশ করে মাবিয়া বলেন, ‘শরীর বেশি খারাপ করলেই আসা হয়। এ ছাড়া আসি না। ডায়াবেটিসের সঙ্গে কিডনির সমস্যা বাড়ছে। এত খরচ কুলাতে পারি না।’
বিশ্বে ডায়াবেটিস চিকিৎসা ব্যয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম স্থানে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগী এক কোটি ৩০ লাখের মতো। এর মধ্যে মাত্র ৫৯ লাখ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। বাকি ৭১ লাখ রোগী চিকিৎসার বাইরে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়াবেটিস রোগ শনাক্ত থেকে শুরু করে চিকিৎসার সবটুকু খরচ এখন পর্যন্ত রোগীর নিজের পকেট থেকে করতে হয়। রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে ব্যয়, তা বেশির ভাগ রোগী চালিয়ে যেতে পারে না। এতে শরীরে অন্যান্য রোগ বাসা বাঁধে। তখন রোগীর চিকিৎসার ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। একসময় রোগীর পরিবার নিঃস্ব হয়ে হাল ছেড়ে দেয়।
মাবিয়ার মতো বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অন্তত ১০ জন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও চিকিৎসার আনুষঙ্গিক ওষুধ ও সরঞ্জামের দাম বাড়ায় রোগীপ্রতি খরচ বেড়েছে দুই থেকে চার হাজার টাকা।
শাহবাগ এলাকার বিভিন্ন ওষুধের দোকান ঘুরে জানা গেছে, ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষার স্ট্রিপ সিনোকেয়রের কৌটা গত বছরে ছিল ৩৭০ টাকা, বর্তমানে তা ৪০০ টাকা। স্ট্রিপ অ্যাকুচেক অ্যাকটিভ ২৫টির প্যাক আগে ছিল ৮০০ টাকা, এখন তা এক হাজার ১০০ টাকা। হিমুলিন ছয়টি ভায়ালের এক প্যাকেটের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। আগে ছিল দুই হাজার ৪০০ টাকা, বর্তমানে তা দুই হাজার ৬০০ টাকা। র্যানটাস এক হাজার ২৯০ টাকার প্যাকেট হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। কমপ্রিড ট্যাবলেট সাত টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে আট টাকা। ডায়মোরাল ট্যাবলেট আট থেকে বেড়ে ১২ টাকা হয়েছে। রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণে অ্যাটোভা ১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট প্রতিটি ১০ থেকে বেড়ে ১২ টাকা, রসুভা ১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ২০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৬ টাকা। এর সঙ্গে গ্যাস্ট্রিকের সারজেল-২০ ট্যাবলেটের দাম সাত থেকে বেড়ে ৯ টাকা, প্রসিপটিন প্রতিটি ৪০ এমজি ট্যাবলেট ছয় থেকে বেড়ে ৯ টাকা, ফিনিক্স-২০ এমজি পাঁচ থেকে বেড়ে সাত টাকা, উচ্চ রক্তচাপের জন্য এবে ক্যাব ৫+২০ ট্যাবলেট ১০ থেকে বেড়ে ১২ টাকা, উচ্চ রক্তচাপের আরেকটি ওষুধ ওসারটিল ৫০ এমজি ট্যাবলেটের দাম আট থেকে বেড়ে ১২ টাকা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের জন্য অ্যাঙ্কর ২.৫ ট্যাবলেট ছয় থেকে বেড়ে ১০ টাকা হয়েছে। ইউরিন ইনফেকশনের জন্য ইউরোম্যাক্স ট্যাবলেট প্যাকেটপ্রতি ২৬০ টাকা থেকে বেড়ে ২৮০ টাকা, ক্যালসিয়াম ও হাড়ের দুর্বলতা বা প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির চিকিৎসার ব্যবহৃত ড্রাইক্যালট্রল প্লাস ট্যাবলেট ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩ টাকা হয়েছে।
বাংলামোটর এলাকার ওষুধ বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কাঁচামাল সংকটের কারণে কম্পানিগুলো উৎপাদিত ওষুধের দাম বাড়ানোয় আমাদেরও বাড়তি বিক্রি করতে হচ্ছে। গত এক বছরে ওষুধের দাম গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।’
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ মঙ্গলবার ২৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে পালিত হচ্ছে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস। এবারের প্রতিপ্রাদ্য বিষয় ‘ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সর্বক্ষণ, সুস্থ দেহ, সুস্থ মন’। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি আলোচনাসভার আয়োজন করেছে। আজ এই সমিতির ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
বারডেম একাডেমির পরিচালক ও এন্ড্রোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় প্রায় ২০ শতাংশ ইনসুলিন নেন। আর আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের ৫০ শতাংশ ইনসুলিন নেয় না। অন্যান্য জটিলতা যাদের রয়েছে, তাদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ৫০ শতাংশ মানুষ জানেন না যে তাঁরা ডায়াবেটিসে ভুগছেন। ২০২১ সালে আমরা এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর সার্ভে করি, যাঁরা ডায়াবেটিস নেই বলে জানেন। স্ক্রিনিংয়ে দেখা গেছে, প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব সার্ভে অনুযায়ী, আরো অনেক বেশি মানুষ ডায়েবেটিসে আক্রান্ত।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ড্রোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম বলেন, ‘ডায়াবেটিস চিকিৎসা তো ব্যয়বহুল। এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। যখন রোগীর খরচ বাড়ে, তিনি তখন চিকিৎসককে দোষারোপ করেন। ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানির অভাবে ওষুধের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ক্ষেত্রে সরকারি খরচ খুবই কম। প্রায় পুরো টাকাই রোগীকে বহন করতে হয়। এ জন্য ওষুধপথ্য কিনতে ধকল পোহাতে হয়। বেশির ভাগ ইনসুলিন দেশের বাইরে থেকে আসে। এটাও ওষুধের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।’
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ বলেন, সব কিছুর দাম যখন বাড়ছে, ডায়াবেটিক রোগীদের খরচ বাড়াও স্বাভাবিক। তবে আশার কথা হলো, টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীদের ইনসুলিনটা সরকার ফ্রি দেবে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে। পর্যায়ক্রমে সরকার টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীদেরও ইনসুলিন ফ্রি করে দেবে। এর সঙ্গে মুখের ওষুধ পাওয়া যাবে।’
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। নিয়মিত পরীক্ষা করে ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে হৃদরোগ, কিডনি, চোখের সমস্যাসহ অন্যান্য রোগ দেখা দেয়।
সোর্স : কালের কন্ঠ