রোজা শুরু হতে আর মাত্র ২২ দিন বাকি। প্রতি বছর রোজার মাসে বেশি চাহিদা থাকে তেল, চিনি, ছোলা, আদা, ডাল, খেজুর প্রভৃতি পণ্যের। ইতোমধ্যে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্য নিত্যপণ্যের দামেও ঊর্ধ্বগতি। উদ্বেগ বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানির দাম, ডলার ও এলসি সঙ্কটে দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই। বাজার পরিস্থিতি যাই হোক, এবারও রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মহল। এমনকি যেসব ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে দাম বাড়িয়েছেন সেসব ব্যবসায়ীরাই আসন্ন রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সঠিকভাবে পেলে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন। যদিও ব্যবসায়ীদের কথাতেও অন্যান্য বারের মতোই থাকছে ব্লেইম গেম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় পণ্য কম থাকলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। তবে আমদানিকারক, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং সরবরাহকারীরা যদি বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ করে তাহলে আসন্ন রমজানে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। বাজার স্বাভাবিক থাকবে। ব্যবসায়ীদের দাবি, বৈশ্বিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, ডলার সঙ্কটে এলসি খোলায় সমস্যার কারণে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। বাধ্য হয়ে তারা পণ্যমূল্য সমন্বয় করছেন। অস্বাভাবিকভাবে কোনো পণ্যের মূল্য বাড়ছে না। কিন্তু রমজান শুরুর আগেই দ্রব্য মূল্যের আগাম ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যবসায়ীদের এমন আশ্বাসে ভরসা নেই জনগণের। তারা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের মতো এ রমজানেও অসাধু ব্যবসায়ী চক্র পুরোনো ছকে চলছে। রমজাননির্ভর পণ্যের দাম তারা আগেই বাড়াতে শুরু করেছে, যাতে রমজানে নতুন করে বাড়ানোর প্রয়োজন না পড়ে।
অবশ্য পণ্যের দাম নিয়ে ব্লেইম গেম নিয়ে চিন্তিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ নিজেও। তিনি বলেন, রমজানে মানুষের প্রত্যাশা বেশি থাকে। আমরা সবসময় দেখি ব্লেইম গেম। পাইকাররা বলে রিটেইলাররা বেশি নিচ্ছে। আবার রিটেইলাররা বলে পাইবাররা বেশি নিচ্ছে। একজন আরেকজনের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। তাহলে কে সঠিক? এক সাথে তো সবাই সঠিক হতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই এই দৃশ্য দেখে আসছি। তাহলে নিশ্চয় এর মধ্য থেকে কেউ সুযোগ নিচ্ছেন। এই বিষয়টা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাজার অর্থনীতিতে সব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া যায় না। তবে বাজার অর্থনীতির একটি নিয়ম রয়েছে। পণ্যের দাম, খরচ এবং লাভ মিলিয়ে দাম নির্ধারণ করতে হয়। তবে যখন দেখি বাজার অর্থনীতির সঙ্গে দামের মিল থাকে না তখন সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। আপনারা সঠিক নিয়মে ব্যবসা করলে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়বে না। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। ১৭ কোটি মানুষের লাখ লাখ ব্যবসায়ী। প্রত্যেক লোককে পাহারা দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সবাইকে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রাইস নির্ধারণ করে দেব, সেটা মানতে হবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, অস্বাভাবিক কিছু কাজের জন্য সবাইকে ব্লেম নিতে হয়। দুই-একজন অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য সবার সুনাম নষ্ট হয়। তিনি বলেন, রমজান আসলে বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অনেক জিনিসের দাম কমানো হয়। অনেক জিনিসপত্রের বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। ছাড় দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটার উল্টোটা দেখা যায়। আমরাও এবার রমজানে সেই ধরনের কালচার তৈরি করতে চাই। এটা চাইলেই সম্ভব।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে প্রতিযোগীতা নেই। যে প্রতিযোগীতা আছে সেটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই অসুস্থ প্রতিযোগীতা বন্ধ করতে হবে। এ জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও সোচ্চার হতে হবে। বাজারে যদি সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে তবে পণ্যের মান ভালো হয়। ব্যবসায়ী-বিক্রেতা-ভোক্তা সবাই লাভবান হয়। গোলাম রহমান বলেন, আমাদের ভোক্তাদের একটা সমস্যা হলো রমজান বা কোনো ক্রাইসিস সময় হলে একসঙ্গে অনেক জিনিস কিনে রাখে। অনেক সময় অপচয়ও করে। এতে বাজার আরও সঙ্কটের মধ্যে পড়ে যায়। এই জিনিসটা বন্ধ করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশে রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যায় এমন পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫-৩০ শতাংশ বাড়তি থাকবে বলে আশঙ্কা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছরের দামের সাথে এ বছরের দাম যদি এক হয়, তারপরও ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হবে। তিনি জানান, রমজান মাসে বাজারে তেল, ছোলা, খেজুর, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে পণ্যের বাজারে কোনো ধরনের ঘাটতি নেই বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। অধিদফতর বলছে, বাজারে পণ্যের ঘাটতি না থাকলেও, ব্যবসায়ীরা যোগসাজস করে পণ্যের দাম বাড়ায় যাতে বাজার অস্থিতিশীল করা যায়। অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন, বাজারে বর্তমানে ছোলাসহ সব ধরনের ডাল, খেজুর এবং চিনির ঘাটতি রয়েছে, যার কারণে এরইমধ্যে এসব পণ্যের দামও বেড়েছে।
সরেজমিনে বাজার ঘুরে খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ইতোমধ্যে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যেরই দাম এক মাস আগের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে সেগুলোও রয়েছে। যদিও রমজান মাস শুরু হতে আরো দেড় মাসের মতো বাকি রয়েছে।
রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী আলম হোসেন বলেন, বিভিন্ন মানের ছোলা ৯০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগের তুলনায় ছোলায় কেজিতে ১৫-২০ টাকার মতো বেড়েছে বলে জানান তিনি। খেজুরের ক্ষেত্রে মান ভেদে দাম, অনেক ক্ষেত্রে, দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানান আলম।
তিনি বলেন, আগে যেটা আপনার ৫০০-৬০০ টাকায় আনা যেতো, সেইটা এখন ৮০০-৯০০ টাকা লাগে। এক হাজার টাকাও লাগে কোনো জায়গায়। এছাড়া বিভিন্ন রকমের ডালের দাম বেড়েছে। অ্যাংকার (এক ধরনের ডাল), খেসারি-এসব ডালের দাম বেড়েছে। মসুরের ডাল কেজি প্রতি ২-৪ টাকা বেড়েছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ১৮ তারিখে শবে-মেরাজের পর সব ধরনের ডাল এবং ছোলার দাম আরো বেড়ে যাবে।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী আজিজুল হক বলেন, ভাল মানের ছোলা, যেটা গত বছর প্রতি মণ তিন হাজার টাকা করে ছিল, সেটি এবার বেড়ে ৩৬০০ টাকা হয়েছে। তবে রোজার সময় ছোলার দাম আরো বেশি বাড়বে বলে জানান তিনি। মসুরের ডাল মান ভেদে ৮৮ টাকা থেকে শুরু করে ১৩২ টাকা কেজি করে পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ী নেতা হেলাল উদ্দিন বলেছেন, আসন্ন রমজানে আমরা সকল ব্যবসায়ী লাভ কম করবো। ভোক্তারা যাতে ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখব। ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকলে আসন্ন রমজান মাসের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় ৬টি পণ্য (চাল, ডাল, তেল, ছোলা, চিনি, ও খেজুর)-এর মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিবে সেই দাম প্রত্যেক দোকানে টানিয়ে রাখা হবে। যাতে কোনোভাবেই ভোক্তারা প্রতারিত না হয় এবং ব্যবসায়ীরাও সুযোগ নিতে না পারে।
সোর্স : ইনকিলাব