হাতিরঝিলে ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাকে বাঁচিয়েছে পুলিশ। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হাতিরঝিলে ঘটে এ ঘটনা। হাতিরঝিল থানার পুলিশ জানায়, হাতিরঝিলে একটি ব্রিজের উপর থেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তা দেখে পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয়রা। পুলিশ গিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে একটি ইউনিট এসে তরুণীকে ব্রিজ থেকে নিচে নামিয়ে আনেন। তাকে হাতিরঝিল থানায় নিয়ে আসা হলে জানা যায়, আত্মহত্যার চেষ্টা করা তরুণী মানসিকভাবে বিষণœ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণী পুলিশের সঙ্গে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন। পরে তার পরিবারকে খবর দেয়া হলে তারা থানায় আসেন। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে তরুণীকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠানো হয়। এর আগে আজিমপুরে একটি বাসায় জ্যোতি ঘোষ নামে এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্রামফোর্ড ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
বিজ্ঞাপন
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মেহেদী হাসান নামে এক সাবেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মেহেদী হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স বিভাগের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাবেক শিক্ষার্থী। এক বছর আগে তার মা মারা যাওয়াতে বিষণœতায় ভুগছিলেন। এসব আত্মহত্যার পেছনে মূল কারণ অভিমান বলে দাবি করেছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে স্কুল পর্যায়ে ৩৪০, কলেজে ৪৪৬ জন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৪ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। আত্মহত্যায় ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে মেয়েরা। চলতি বছরের ২৭শে জানুয়ারি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। পরিসংখ্যান বলছে-নারীদের আত্মহত্যার সংখ্যাই বেশি। স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী রয়েছেন ৬০.৯০ শতাংশ এবং পুরুষ রয়েছেন ৩৬.১ শতাংশ। শুধু স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যাকারী নারী শিক্ষার্থীর পরিমাণ ৬৫.৩ শতাংশ। এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৩৪.৭ শতাংশ।
আত্মহত্যায় শীর্ষে ঢাকা। সারা দেশের মোট ৮টি বিভাগের মধ্যে আত্মহত্যাকারী স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে যা ২৩.৭৭ শতাংশ। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭.২৭ শতাংশ এবং রাজশাহী বিভাগে ১৬.৮১ শতাংশ। গত বছর সর্বাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এপ্রিল মাসে। স্কুল এবং কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে গত বছর প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩৭ জন স্কুল এবং কলেজগামী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আর এসব আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা গেছে, মান-অভিমান তাদের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে। অন্য কারণের মধ্যে রয়েছে প্রেমঘটিত কারণ, পারিবারিক কলহ, হতাশাগ্রস্ততা, মানসিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া, শিক্ষক কর্তৃক অপমানিত হয়ে, গেইম খেলতে বাধা দেয়ায়, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে, মোবাইল ফোন কিনে না দেয়ায়, মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
আত্মহত্যা ঠেকাতে সিআইডি’র সাইবার মনিটরিং সেল ‘রাউন্ড দ্য ক্লক’ ২০১৮ সাল থেকে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কথা হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি’র সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো শিক্ষার্থী যদি ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার পদক্ষেপ নেয় সেক্ষেত্রে আমরা সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ পেয়ে ঘটনাস্থলে রেসকিউ টিম পাঠাই। কিংবা স্থানীয় থানাকে অবগত করি। এসব ক্ষেত্রে আমরা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কিংবা তার পরিবারকে পরবর্তীতে বিশেষ কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করে থাকি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক মো. রাজিব বলেন, আমাদের এখানে বিভিন্ন বয়সের রোগীদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। শিক্ষার্থী এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য রয়েছে বিশেষ কাউন্সিলিং ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এক্ষেত্রে শিক্ষক, বাবা-মা এবং শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে কাউন্সিলিং করা যেতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরা প্রতি মাসে একবার করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশেষ সভার মাধ্যমে তাদের সমস্যা, সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে কথা বলতে পারেন। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ মানবজমিনকে বলেন, অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয় হলো ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা সর্বাধিক। এ সময় শিক্ষার্থীরা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিভিন্ন কারণে এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। একটি মেয়ে কালো বলে তাকে বডি শেমিং করা হয়। পরীক্ষায় বাবা-মায়ের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। এ ছাড়া আমাদের সামাজিক এবং পারিপাশি^ক বিষয়তো রয়েছেই। বাবা-মাকে তাদের সন্তানের মনের কথা শুনতে হবে। শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীবান্ধব হতে প্রশিক্ষণসহ সরকারের কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এ ধরনের ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে বলে জানান তিনি।
সোর্স : মানবজমিন