চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে শিবির সন্দেহে ৪ শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনার পর পার হয়ে গেছে ১৯ দিন। তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনো নেয়া এখনো নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। এই ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষের করা তদন্ত কমিটির ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও তারা এখনো তা দেয়নি। এদিকে নির্যাতনকারী সেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে বহাল তবিয়তেই আছেন। এমনকি যে তিনটি রুমে রাতভর নির্যাতন চালানো হয়েছিল, কলেজ কর্তৃপক্ষ সেগুলো সিলগালা করলেও অভিযুক্তরা তালা ভেঙে এখন সেখানে অবস্থান করছে। আর ভয়-আতঙ্কে এই নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা ফিরতে পারেননি ক্লাসে। এমনকি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া মোবাইল পর্যন্ত এখনো ফেরত দেয়া হয়নি।
এর আগে ৮ই ফেব্রুয়ারি রাতে চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষ থেকে শিবির সন্দেহে চার শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা হলেন- চমেকের ৬২তম ব্যাচের ছাত্র আবু রাইয়ান, মোবাশ্বির হোসাইন শুভ্র, জাহিদ হোসাইন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেন। আহতদের মধ্যে জাহিদ হোসাইন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি বাড়িতে চলে যান। তারা ৪ দিন আইসিইউতেও ছিলেন।
আর আবু রাইয়ান কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মুবাশ্বির শুভ্র নারায়ণগঞ্জে একজন অর্থোপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা শেষে বাড়িতে আছেন। তাদের শারীরিক অবস্থা অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তবে তারা এখনো ভয় আর আতঙ্কের মধ্যেই আছেন।
ভুক্তভোগী জাহিদ হোসেন ওয়াকিল রোববার বিকালে মানবজমিনকে বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে গত রোববার আমাদের দু’জনকে ডিসচার্জ দিয়েছিল। এখন বাড়িতে আছি। আমার আগের চেয়ে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে ব্যথা যায়নি। পুরো শরীরে এখনো ব্যথা। আর সেই রাতের কথা প্রতিনিয়ত মনে পড়ছে। সেটা মনে পড়লে আর কিছু ভালো লাগে না। সেই রাতে যা হয়েছে তা ভুলতে পারবো না।
ওয়াকিলের ভাই মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ওয়াকিলের শারীরিক অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তবে মানসিকভাবে সে অনেকটা ভেঙে পড়েছে। টানা কয়েক রাতে ঘুম থেকে চিৎকার দিয়ে উঠে যায়। বিড়বিড় করে কি সব বলে। তাকে নিয়ে আমরা পুরো পরিবার খুব টেনশনে আছি। এই মুহূর্তে তাকে ক্যাম্পাসে পাঠানো ঠিক হবে কিনা সেটাই চিন্তা করছি।
নির্যাতিত শিক্ষার্থী মোবাশ্বির হোসেন শুভ্রের মা আফসানা বেগম মানবজমিনকে বলেন, আমার ছেলে শারীরিকভাবে এখন অনেকটা সুস্থ। তবে সে এখনো অনেকটা ট্রমার মধ্যেই আছে। আশা করছি সে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আর কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কয়েক দফা যোগাযোগ হয়েছে। তারা আসতে বললে আমরা তাকে পাঠিয়ে দিবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ওই দিন রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমার ব্যাচেরই কয়েকজন এসে আমাকে একটি রুমে নিয়ে যায়। এরপর কিছু বলার আগেই লাঠি, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প দিয়ে মারতে থাকে। সেখানে আরও একজন ছিল। তাকেও মারতে থাকে। প্রায় ৩ ঘণ্টা আমাদেরকে মারা হয়। তারা আমাদের দুই জনের মোবাইল নিয়ে নিয়েছে। বাকি দু’জনের গুলোও নিয়ে নিয়েছে। এগুলো এখনো পর্যন্ত ফেরত দেয়া হয়নি।
এই শিক্ষার্থী বলেন, যতক্ষণ না নিজেদেরকে শিবির বলে স্বীকার করেছি ততক্ষণ তারা আমাদেরকে বেধড়ক মার মেরেছে। এক পর্যায়ে পিটুনি থেকে বাঁচতে আমরা শিবির বলে স্বীকার করে তাদের লিখিত কাগজে সাইন দিয়েছি। এসব আবার তারা মোবাইলেও ধারণ করেছে। যদিও আমরা কখনো শিবির করিনি। আমার পরিবারেও কেউ শিবির নেই। আর যদি আমি শিবির করেই থাকি, তাহলে সেটা কলেজ প্রশাসন দেখবে। থানা পুলিশ দেখবে।
এদিকে নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিজিৎ দাশ, রেয়াজুল ইসলাম জয়, জাকির হোসেন সায়াল, মাহিন আহমেদ ও ইব্রাহিম সাকিবসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযুক্তরা সবাই ক্যাম্পাসে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী বলে পরিচিত। এদের মধ্যে অভিজিৎ ও জয় ক্যাম্পাসে মারামারির ঘটনায় আড়াই বছরের জন্য বহিষ্কৃত। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা হোস্টেল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে। যদিও এই ৮ই ফেব্রুয়ারি ঘটনায় তাদের ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহৃত ৩য় তলার ১৭-এ, ১৮-এ ও ১৯-এ নাম্বার রুম সিলগালা করে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে তিন দিনের মাথায় তারা তালা ভেঙে ফেলে। এখন তারা সেই রুমগুলোতে অবস্থান করছেন।
এদিকে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চমেক অধ্যক্ষ ডা. শাহানা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, আমাদের ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটির ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা হয়েছিল। তবে ঝামেলাটা জটিল হওয়ায় কমিটি আরও কয়েকদিন সময় চেয়েছে। এরমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে, তারাও একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। তাদের (নির্যাতিত শিক্ষার্থী) বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠন কানেকশানের অভিযোগ দিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিবেদন পেতে একটু দেরি হচ্ছে।
সিলগালা করে দেয়া রুমের তালা ভেঙে এই নির্যাতনকারীদের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শাহানা বলেন, এটি ঠিক বলতে পারবো না। আমি নিজে গিয়েই তো সিলগালা করেছিলাম। বিষয়টির আমি খোঁজ নিচ্ছি।
সোর্স : মানবজমিন