উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ায় এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। দুই বছর আগে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ কমাতে নতুনভাবে শুরু করা হয় সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু এই গুচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমেও ভর্তিপ্রক্রিয়ার দুর্ভোগ কমেনি। গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের বছরজুড়েই দৌড়াতে হচ্ছে। ফলে যে উদ্দেশ্যে বা দুর্ভোগ কমাতে গুচ্ছপদ্ধতির পরীক্ষা শুরু হয় তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এক বছর পরও দেখা গেছে গুচ্ছভুক্ত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই আসন ফাঁকা রয়েছে। এ দিকে গুচ্ছ পরীক্ষার পদ্ধতিগত ত্রুটি বা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এগুলোর সমাধানের পথ খুঁজতে আজ সোমবার গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের ডেকেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার হয়রানি বন্ধ ও অর্থ ব্যয় কমাতে গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি শুরু হয় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে। অথচ দুই বছরের ব্যবধানে এ পদ্ধতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অনেক অভিভাবকই গুচ্ছ পরীক্ষার পদ্ধতিগত ত্রুটির নানা দিক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, যে উদ্দেশ্যে গুচ্ছ পরীক্ষা শুরু করা হয়েছিল তা কাজে আসেনি। সময় কমাতে এই পরীক্ষা শুরু হলেও প্রকারান্তরে এখন আগের চেয়েও বেশি সময় লাগছে। চলতি বছরেও দেখা গেছে গত শিক্ষাবর্ষের ভর্তিকার্যক্রম শেষ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ অবস্থায় সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সেই লক্ষ্যে আসন্ন ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে নিয়ে আজ সভায় বসছেন শিক্ষামন্ত্রী। বেলা ২টার দিকে এ সভা হতে পারে। সেখানে গুচ্ছ ভর্তির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে। সভায় ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি নেতাদের ডাকা হয়েছে। এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দাবি তুলেছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক সমিতির নেতাদের ডাকা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে বৈঠকথ করবেন শিক্ষামন্ত্রী। সেখানে কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য উপস্থিত থাকবেন। গুচ্ছের সমস্যা ও সমাধান করতে শিক্ষকদেরও ডাকা হয়েছে। একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার বিষয়ে ভিসিদের কিছু বিষয় থাকবে। সেগুলো সভায় উপস্থাপনের চেষ্টা করবেন।
সময় কমিয়ে আনা হচ্ছে গুচ্ছ পরীক্ষার : এর আগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গুচ্ছ কমিটির সভায় ভিসিরা একসাথে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে একমত হন। যদিও জগন্নাথ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে থাকার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। তবে তারা শেষ পর্যন্ত থাকবেন বলে দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন। ওই দিনের সভায় প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়, আগামী জুলাইয়ের মধ্যে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। ভর্তি ইচ্ছুকরা যেসব বিষয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন, সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেবে কর্তৃপক্ষ। নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে আসবে কি না, তা আরো পরে জানানো হবে। আগামী মে মাসে ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে। এদিকে গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) থাকছে কি না, এ বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত বুধবার অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বিশেষ সভা হওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে দিনক্ষণ পিছিয়ে দেয়া হয়।
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা : সূত্র জানায়, গত বছরের ১ এপ্রিল আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই গুচ্ছ ভর্তি কার্যক্রম বর্তমানে শেষ হয়েছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অবশিষ্ট ২১ বিশ্ববিদ্যালয়েই সর্বনিম্ন ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৫৩০টি পর্যন্ত আসন ফাঁকা রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসের প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পরও ভর্তি হয়নি অনেক শিক্ষার্থী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা রয়েছে ৩৫২টি। এর মধ্যে ‘এ’ ইউনিটে ৩৪১ টি, ‘বি’ ইউনিটে ৪টি এবং ‘সি’ ইউনিটে ৭টি আসন ফাঁকা রয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা রয়েছে ৩৭৮টি। এর মধ্যে ‘এ’ ইউনিটে ২৮৮টি, ‘বি’ ইউনিটে ৪টি এবং ‘সি’ ইউনিটে ২টি আসন ফাঁকা রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা রয়েছে ৫২৯টি, যার মধ্যে ‘এ’ ইউনিটে ৩৬১টি, ‘বি ইউনিটে ১১৪টি, এবং ‘সি’ ইউনিটে ৫৪টি আসন ফাঁকা রয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮টি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০০টি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৮৯টি আসন ফাঁকা রয়েছে। উল্লেখ্য ২০২২ এর ৩০ জুলাই, ১৩ আগস্ট এবং ২০ আগস্ট যথাক্রমে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ, বি এবং সি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
আসন কেন ফাঁকা থাকছে : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিতে একটি সিটের জন্য তুমুল প্রতিযোগিতা হয়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিট অর্জন করে নেয় মেধাবী শিক্ষার্থীরা। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। এত শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েও কেন আসন ফাঁকা রয়ে গেল এবং কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফাঁকা আসন রেখেই ভর্তিকার্যক্রম স্থগিত করল তার কিছু কারণ যেমন রয়েছে, আবার সেগুলোর যথোপযুক্ত সমাধানও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষার্থীর নম্বর বেশি তারা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছে তাই যাদের নম্বর কম তারা প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকেন। এ ক্ষেত্রে গণবিজ্ঞপ্তিতে ভর্তি নিলে কার্যক্রম দ্রুত শেষ করা যাবে।
আবার অনেক শিক্ষার্থী অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয় পেলে চলে আসে এবং আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা হয়। তাই দ্রুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁকা আসনে ভর্তি নিলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসন ফাঁকা হওয়া মাত্রই ভর্তিকার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে পারবে। ফলে অনেক শিক্ষার্থীর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সঙ্কটের কারণে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে অনীহা রয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় এক হাজার আসন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে আসন ফাঁকা রাখায় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। ফাঁকা আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো উচিত কারণ যেসব শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের যোগ্যতা রয়েছে বলেই মেধার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ভর্তি করালে বিশ্ববিদ্যালয়েরই সুনাম সমুন্নত হবে ভবিষ্যতে। আবাসন সঙ্কটের অজুহাতে আসন ফাঁকা রেখে ভর্তি স্থগিত রাখা কোনো সমাধান নয়।
শিক্ষাবিদরা জানান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা রেখে ভর্তি স্থগিত করার প্রবণতা উচ্চশিক্ষায় ইতিবাচক বার্তা নয়। উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ও ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ফাঁকা আসনে ভর্তি নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। ফাঁকা আসনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকার।
সোর্স : নয়া দিগন্ত