দিন মাস ও বছর পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে রাস্তাঘাটের অবস্থায়ও উন্নতি হবে বলে অন্য সব মানুষের মতো আমারও ধারণা ছিল। কিন্তু সেটা ঘটেনি। এ পর্যন্ত এসেই এসেছে শতকরা অংকের হিসাব প্রসঙ্গ। পাঠকরা নিশ্চয়ই সহজে বুঝতে পারবেন, ৯৫ শতাংশ বলতে ঠিক কতজনকে বোঝানো হয়। নিবন্ধের শুরুতে কথাটা বলতে হচ্ছে বিশেষ কারণে। রাজধানী ঢাকার যানজট পরিস্থিতি সে বিশেষ কারণ। একথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঢাকা শহরের ৯৫ শতাংশ অর্থাৎ একশ’জনের মধ্যে ৯৫ জনই যানবাহনে চলাচল করতে গিয়ে প্রচন্ড কষ্ট ও ভোগান্তির শিকারে পরিণত হচ্ছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ অনেক সংগঠনই বহুদিন ধরে কথাটা জানিয়ে চলেছে।
গতকাল ২৬ ফেব্রুয়ারির একটি জাতীয় দৈনিকেও বিষয়টি নিয়ে প্রধান রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের রিপোর্ট আসলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। একযোগে প্রকাশিত হচ্ছে নানা সংগঠনের পর্যবেক্ষণ রিপোর্টও। এসব রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, শুধু অসন্তোষ নয়, ৯০ শতাংশ মানুষই রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ৯৮ শতাংশ যাত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, তাদের সবাই প্রতিদিন ভাড়া নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছেন। যার কাছ থেকে যেভাবে যতো ইচ্ছা সেভাবেই ভাড়া আদায় করছে বাস ও অন্যান্য পরিবহনের লোকজন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আপত্তি বা প্রতিবাদ জানানোর কোনো উপায় নেই। কারণ, যাত্রীদের তারা জিম্মি বানিয়ে ফেলে। পাশাপাশি রয়েছে নির্ধারিত স্টপেজের ধার না ধেরে যেখানে-সেখানে অনেকটা ‘ঘাড়ে ধরে’ যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া। নতুন যাত্রীদের ওঠানোর ক্ষেত্রেও স্টপেজ বা আইনের কোনো তোয়াক্কা করছে না বাসসহ বিভিন্ন পরিবহনের হেল্পার-কন্ডাক্টররা। প্রধান রিপোর্ট প্রকাশকারী দৈনিকটি আবার একই সঙ্গে জানিয়েছে, সড়কে বিশৃংখলা ‘জিইয়ে’ রাখার ব্যাপারে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে চমৎকার মতৈক্য রয়েছে এবং প্রতিটি পক্ষ এসব বিষয়ে ‘একজোট’ হয়ে কাজ করে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন প্রশ্নে ১১ দফা দাবি জানিয়ে সম্প্রতি তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ চিঠিও পাঠিয়েছে।
এই দাবিনামার মধ্য দিয়েও যাত্রীদের তথা সাধারণ মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তির একটি প্রধান কারণ হিসেবে রাস্তার যানজটকে প্রাধান্যে আনা হয়েছে। বস্তুত রাজধানী ঢাকার এই যানজট বহুদিন আগেই একটি প্রাত্যহিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। টিভি ও সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমেও যানজট নিয়ে নিয়মিতভাবে সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। এসব রিপোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শত শত গাড়ির একই স্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাসহ সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের বিবরণ তো থাকছেই, পাশাপাশি থাকছে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কথাও। বিষয়টি নিয়ে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাও যথেষ্টই হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যানজট সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগের অবসান হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমান সময়ের যানজট প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তথ্যটি হলো, কেবলই যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার এবং ট্রাফিক পুলিশের অব্যবস্থাপনার মতো কোনো কারণে নয়, প্রধান কারণ হিসেবে এসেছে মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের কার্যক্রম। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মিরপুর-শ্যাওরাপড়া ও ফার্মগেট-বাংলামোটর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় প্রেস ক্লাব হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের কাজ চলছে বছরের পর বছর এবং মাসের পর মাস ধরে। যেসব এলাকায় নির্মাণ কাজ চলছে সেসব এলাকায় প্রধান সড়কগুলোকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে মাঝখানের অংশে। এর ফলে রাজধানীর বিরাট এলাকাজুড়ে সড়কগুলো সংকুচিত হয়ে গেছে আর যানবাহনের প্রচন্ড চাপে স্থবির হয়ে পড়েছে পুরো রাজধানী। মিরপুর ও ফার্মগেট থেকে মতিঝিল যাওয়ার পথে শত শত যানবাহন প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছে একই স্থানে। পরিণতিতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব দেখা ও জানা সত্ত্বেও সরকার এমন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, যার ফলে নির্মাণ কাজ দ্রুত সমাপ্ত হবে। বাস্তবে সবই চলছে অতি ধীর গতিতেÑ যাকে বলে ‘শম্ভুক গতি’। এ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য হিসেবে মেট্রোরেল চালু করার খবরের উল্লেখ করা যায়। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করা হলেও শতকরা হিসেবে মাত্রই ১৫ থেকে ২০ ভাগ চালু হয়েছে। সেটুকুও চলছে বিচ্ছিন্নভাবে।
পর্যবেক্ষরা বলেছেন এবং আমরাও মনে করি, মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের নামে রাজধানীকে স্থবির করে ফেলার চলমান কার্যক্রম সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কারণ, মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য মহানগরীর বিভিন্ন অংশে কয়েক বছর সময় নষ্ট করা হয়েছে। মেট্রোরেলের জন্যও একইভাবে নষ্ট হচ্ছে মাসের পর মাস। আশংকা ও আপত্তির কারণ হলো, এই নির্মাণ কাজ আরো কতদিন চলবে সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে কিছুই জানানো হচ্ছে না। অথচ যে গতিতে নির্মাণ কাজ চালানো হচ্ছে কোনো দেশের রাজধানীতে অমন ধীর গতিতে এত বিরাট ধরনের নির্মাণ কাজ চালানো যায় না। চালানো হয়ও না। কিন্তু সব জেনে বুঝেও সরকার এখনো নীরবতাই অবলম্বন করে চলেছে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে উদ্বেগের প্রধান একটি কারণ উল্লেখ করা দরকার। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক এক গবেষণা রিপের্টে জানিয়ে রেখেছে, তীব্র যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন মানুষের ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর অর্থের দিক থেকে প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকার। সে হিসেবে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮৪ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছিল, যানজটের ফলে রাজধানীতে গাড়ির গতি অনেক কমে গেছে। ১০ বছ আগেও ঢাকায় একটি যানবাহন ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতো। ২০১৭ সালে সে একই যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ছয় দশমিক দুই কিলোমিটারে নেমেছে। অথচ একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। সেদিক থেকে যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার গতির প্রায় কাছাকাছি নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা একথাও বলে রেখেছেন, অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটানো গেলে ২০২৫ সালে যানবাহনের গতি আরো কমে ঘণ্টায় মাত্র চার কিলোমিটারে নেমে আসবে। তখন মানুষ হেঁটেই যে কোনো যানবাহনের চাইতে কম সময়ে বেশি দূরত্বে যাতায়াত করতে পারবে।
বিশ্বব্যাংকের ওই গবেষণা রিপোর্টে এমন আরো কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান জানানো হয়েছিল, যেগুলো সকল বিচারেই আশংকাজনক। যেমন ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা ১৩৪ শতাংশ বাড়লেও রাস্তা বেড়েছে মাত্র পাঁচ শতাংশ। এসব রাস্তারও বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রাখে যানবাহন, বিশেষ করে ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ি। বিশ্বব্যাংকের ওই রিপোর্টে শংকিত হওয়ার মতো অন্য একটি তথ্যও জানানো হয়েছিল। গবেষকরা বলেছিলেন, ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ৫০ শতাংশ বেড়ে রাজধানীতে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। এই হারে বাড়তে থাকলে ২০৩৫ সালে দ্বিগুণ বেড়ে রাজধানীর জনসংখ্যা তিন কোটি ৫০ লাখে পৌঁছাবে। বলা দরকার, ওই গবেষণা রিপোর্টটি সব মিলিয়েই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বব্যাংকের গবেষকরা বলেছিলেন, রাজধানীর যানজট সমস্যার অবশ্যই সমাধান করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছিলেন তারা। বলেছিলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ এবং রাস্তায় দ্রুত গতিসম্পন্ন যানবাহন নামানোর পাশাপাশি ঢাকার পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিত নগরায়ন করতে হবে।
অন্যদিকে সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরিবর্তে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের মতো এমন সব কর্মকান্ডই সরকার বেছে নিয়েছে, যেগুলোর কারণে মাসের পর মাস তো বটেই, বছরের পর বছর ধরেও রাজধানীবাসীকে প্রচন্ড কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। প্রশস্ত হওয়ার পরিবর্তে রাস্তাগুলো বরং অনেক সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বাস্তবে প্রতিটি রাস্তার প্রশস্ততাই অন্তত চার ভাগের এক ভাগ কমে যাচ্ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে যাত্রী তথা সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয়ার ও জিম্মি বানানোর অপতৎপরতা।
এমন অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো দরকার। সরকারের উচিত জনবল কয়েকগুণ বাড়িয়ে হলেও মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের কাজকে দ্রুত সমাপ্ত করা এবং যানজটের প্রাত্যহিক ক্ষতি ও যন্ত্রণা থেকে জনগণকে মুক্তি দেয়া। গণপরিবহনের লোকজনসহ কোনো গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেটের পক্ষেই যাতে জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়ানো সম্ভব না হয় সে লক্ষ্যে অবশ্যই দ্রুত কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। শুরুতে বলে আসা ‘৯৫ শতাংশ’ কথাটার অর্থও কর্তা ব্যক্তিদের বুঝতে হবে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম