ঢাকার মুক্তাঙ্গন। অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামের সাক্ষী। প্রতিদিনই ব্যস্ত থাকতো মুক্তাঙ্গন পার্ক এলাকা। যেখানে সবুজ অরণ্যের ভেতরে হতো গণতন্ত্রের চর্চা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংগ্রামের সূচনাও হতো সেখান থেকে। নেতাকর্মীদের জমায়েত, সভা-সমাবেশের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রও ছিল সেটি। কালবদলে হারিয়েছে সেই ঐতিহ্য। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বেদখল হয়ে ছিল মুক্তাঙ্গনটি। রেন্ট-এ- কারের ব্যবসায় চলছিল এই সময়টা। এখন মুক্তাঙ্গন পার্কের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে পাবলিক টয়লেট, ময়লার স্থানান্তর কেন্দ্র ও ভাঙ্গারির দোকান।
এখনও মুক্তাঙ্গনের সামনের রাস্তা রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীদের দখলে। আগের সেই চিরচেনা চিত্র নেই মুক্তাঙ্গনের। চলছে উন্নয়ন কাজ। সেখানে তৈরি করা হচ্ছে পার্ক ও ইনডোর খেলার স্থান। এক সময়ের মুক্ত মত প্রকাশের এই কেন্দ্রটি এখন নিজেই বন্দি। এখানে আর সভা-সমাবেশের সুযোগ থাকছে না। সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, মুক্তাঙ্গন পার্কটির সামনের অংশে টিন ও পেছনের অংশে দেয়াল করে বেড়া দিয়ে রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর ভেতরে চলছে পার্ক উন্নয়ন ও খেলার মাঠের উন্নয়নের কাজ। মুক্তাঙ্গনের সামনের ফটকের রাস্তা দখল করে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসের পার্কিং জোন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে সারি সারি গাড়ি পার্কিং করে রাখা। এসব গাড়ি রেন্ট-এ কারের ব্যবসা করে। একটি যাত্রী ছাউনিও রয়েছে। তবে তা দখল করে এই ব্যবসা করছে মাইক্রোবাস কার মালিক সমিতি। মুক্তাঙ্গনের এক পাশে অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র করেছে ডিএসসিসি। ২০২১ সাল থেকে সেখানে বর্জ্য স্থানান্তরের কর্মযজ্ঞ চলছে। অন্যপাশে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য করা হয়েছে পাবলিক টয়লেট। মুক্তাঙ্গনের সামনে ফুটপাথে অবৈধ দোকানপাটও দেখা যায়। দেখে বোঝার উপায় নেই সেখানে এক সময় মুক্ত ময়দান ছিল।
ডিএসসিসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুুক্তাঙ্গন পার্কটিকে সবুজায়ন করা হচ্ছে। সেখানে শিশুপার্কের আদলে খেলার কিছু সরঞ্জামও রাখা হবে। বাস্কেটবলসহ শিশুদের কিছু রাইডস বসানো হবে।
স্থানীয়রা জানান, এখন মুক্তাঙ্গন পার্কের চিত্র বদলে গেছে। অনেকে জানেনই না এক সময় এই মুক্তাঙ্গন রাজনীতির ইতিহাসের সাক্ষী ছিল। অনেক রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ, সংগ্রামের যাত্রা এই মুক্তাঙ্গন থেকেই শুরু হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মুক্তাঙ্গনটি বেদখল ছিল। জাহাঙ্গীর নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে এখানে কোনো মিছিল-মিটিং হয় না। গাড়ি পার্কিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিটি করপোরেশন পার্কিং সরিয়ে পার্ক উন্নয়নের কাজ করছে। মুক্তাঙ্গনের সামনে পার্কিংয়ে নিয়মিত গাড়ি রাখেন রহিম। অতীতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, মুক্তাঙ্গনে অনেক গাছপালা ছিল। খোলা মাঠ ছিল। একটা বসার জায়গা ছিল। এখানে আগে অনেক মিছিল-মিটিং দেখেছি আমরা। একটা মসজিদও ছিল। কিন্তু এখন সেই মসজিদও নাই। মিছিল-মিটিংও হয় না।
আশির দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী মুক্তাঙ্গন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, মুক্তাঙ্গনও এখন বন্দি হয়ে গেছে। ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে গেছে। এক সময় বায়তুল মোকাররমের সামনে আমরা মিটিং করতাম। সেটা বন্ধ হয়েছে। পল্টন ময়দানও বন্ধ। এখন রাস্তা ব্লক করে মিটিং করতে হয়। মুক্তাঙ্গনটা মুক্ত থাকলে মানুষ মিটিং, সভা-সমাবেশ করতে পারতো। ঢাকায় এখন মুক্তভাবে মানুষের মত প্রকাশ করার মতো তেমন কোনো জায়গা নেই উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ঢাকায় মুক্তাঙ্গনই ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে বিনা খরচে মানুষ কর্মসূচি করতে পারতো। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের জায়গা ছিল মুক্তাঙ্গন। যেকোনো দল চাইলেই সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করার জন্য ব্যবহার করতে পারতো। সেজন্য কোনো অর্থও ব্যয় করতে হতো না। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। বর্তমানে রাজনৈতিক সভা-সমবেশের জায়গাগুলো কে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। সরকার সবসময় এসব জায়গা সঙ্কুচিত করছে। প্রেস ক্লাব বা কিছু জায়গায় সভা-সমাবেশ করতে গেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে করতে হয়। এতে যান চলাচলেও অসুবিধা হয়। এটাও সরকার জনদুর্ভোগের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে।
সিপিবি ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক লুনা নূর বলেন, মুক্তাঙ্গনটা বন্ধ হয়েছে ২০০৮ সালের পর। এক দশকের বেশি সময় ধরে আমরা মুক্তাঙ্গন ব্যবহার করেছি। খোলা মাঠ ছিল, পাশে ছোট দেয়ালও ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পারতো। এটি আমাদের প্রতিবাদ, কর্মসূচি নেয়ার জায়গা ছিল। নেতাকর্মীদের জমায়েতের জায়গাও ছিল। রাস্তার উপরেও কোনো প্রভাব পড়তো না। কিন্তু প্রথমে জিপিও’র দিকের জায়গায় গাড়ি রেখে মুক্তাঙ্গন মাঠ ছোট করা শুরু করলো। এভাবে একটা সময় পুরো দখলে চলে যায়। এখন দাঁড়ানোর জায়গাও নেই।
সোর্স : মানবজমিন