‘কালো টাকা উপাখ্যান’ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই বাজেট এলেই কালো টাকা সাদা করা তথা অর্থের ধবলীকরণ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সম্প্রতি বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কেউ কেউ বিপর্যস্ত শেয়ারবাজারে গতি ফিরিয়ে আনার জন্য কালো টাকা বিনিয়োগের পক্ষে কথা বলছেন। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, ‘ শেয়ারবাজারের কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিলেই বাজার চাঙা হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।’ বিষয়টি নিয়ে অতীত রেকর্ডও খুব একটা সুখকর নয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৮৬ জন ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১ জন করদাতা এই সুযোগ নিয়েছেন। এতে সব মিলিয়ে ৪৩০ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে গেছে। কিন্তু বাজার আশানুরূপভাবে চাঙা হয়নি।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে মোট ২১ বার নানাভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সাধারণত দেশের অভ্যন্তরে উপার্জিত কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেওয়া হয় দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে সুযোগ কেউ গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বারবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সংশ্লিষ্টদের একটি বার্তা দেয়া হয় যে ‘তুমি দুর্নীতি করো, সব বৈধ করে দেয়া হবে’। তাই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতি সহায়ক বলেই মনে করেন অভিজ্ঞমহল। বছরের পর বছর এই সুযোগ দিয়েও কোন ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। আবার কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
শুধু যে আমাদের দেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয় এমন নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তবে কোনো দেশই বাংলাদেশের মতো ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ দেয়া হয়নি। ওই সব দেশ কয়েকবার স্বল্প সময়ের জন্য সুযোগটি দেয়া হয়েছিল। সেসব দেশের নাগরিকেরাও এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন। কারণ, সুযোগ না নিলে শাস্তি প্রদানের হুমকিও দিয়ে রেখেছিল সেই সব দেশ। অথচ বাংলাদেশে ঢালাওভাবে এবং প্রায় সব সময় সুযোগ দেওয়া হলেও এর সুফল পাওয়া যায়নি। কারণ, কালোটাকার মালিকেরা মনে করেন, এই সুযোগ অনন্তকালের জন্য চলতে থাকবে। কারণ, দেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে ৫ থেকে ২০ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর বাইরে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি ক্রয় এবং শেয়ারবাজার ও শিল্প খাতে বিনিয়োগের বিপরীতেও এই সুযোগ মিলে ছিল। তাই কালো টাকার মালিকরা বেশ আত্মপ্রত্যয়ী এবং নিজেদেরকে ঝুঁকিমুক্তই মনে করেন।
মূলত, নৈতিকতার সঙ্গে সমঝোতা করে কালোটাকার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এর কোন সুফল পাওয়া যায় না। আসলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় ও অবিচার করা হয়। সাধারণত সাদামাটা ঘোষণায় কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু সুযোগ না নিলে কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা বলা হয় না। ১৯৭৬ সালে এক আদেশে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। এরপর ২০০৬-০৭ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। প্রকাশ করেছিল সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা। ওই বছর প্রায় ৩২ হাজার করদাতা ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সাদা করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার আসার পর পরিস্থিতি পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে এযাবৎকালের এক বছরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা করা হয়। সেবার জমি-ফ্ল্যাট কিনে ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কিংবা নগদ টাকা সাদা করেছেন ১১ হাজার ৮৫৯ জন ব্যক্তি। কর কর্মকর্তারা জানান, কোভিডের কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সীমিত হওয়ায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন বেশি।
কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ শেষ হওয়ার পর এনবিআর কালোটাকার মালিকদের ধরতে কোনো উদ্যোগও নেয়নি। কাউকে শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থাও করেনি। অথচ আয়কর অধ্যাদেশে অপ্রদর্শিত আয় ধরা পড়লে জরিমানা সহ শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে তা বৈধ উপায়ের আয় হতে হবে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ সম্পর্কে আয়কর অধ্যাদেশে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু বলা নেই।
বাংলাদেশে কত পরিমাণ কালোটাকা আছে, তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়েছে। তবে দিন দিন অর্থনীতিতে কালোটাকার পরিমাণ বাড়ছে তা ওই সব গবেষণায় উঠে এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের অর্থনীতিতে ১৯৭৩ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭ শতাংশের সমপরিমাণ কালোটাকা ছিল। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ কালো টাকা বিরাজমান ছিল। ২০১০ সালে তা সর্বোচ্চ প্রায় ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল।
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মকর্তা লিয়ান্দ্রো মেডিনা ও অস্ট্রিয়ার অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডার ‘শেডিং লাইট অন দ্য শ্যাডো ইকোনমি: এ গ্লোবাল ডেটাবেজ অ্যান্ড দ্য ইন্টারঅ্যাকশন উইথ দ্য অফিশিয়াল ওয়ান’ নামে একটি গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গড়ে জিডিপির ৩৩ শতাংশের মতো কালো টাকা ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী জিডিপির ৩ ভাগের ১ ভাগ পরিমাণও যদি কালো টাকা থাকে, তা ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। অথচ ২১ বার সুযোগ দেওয়ার পর ২০ ভাগের ১ ভাগ কালোটাকাও সাদা হয়নি বরং সার্বিক পরিস্থিতির অবনতিই হয়েছে।
কালো টাকার বৈধতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও পক্ষ-বিপক্ষে আলোচনা থাকলেও অর্থশাস্ত্রে কালো টাকার কোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। অর্থনীতিবিদেরা একে অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল), গোপন (আন্ডারগ্রাউন্ড), অপ্রদর্শিত (আনডিসক্লোজড), লুকানো (হিডেন) বা ছায়া (শ্যাডো) অর্থনীতি বলে থাকেন। আয়কর বিবরণীতে যে আয় প্রদর্শন করা হয়নি, সেটাই ‘অপ্রদর্শিত’। এই অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ বা অবৈধ দু’ভাবেই অর্জিত হতে পারে। যা-ই বলা হোক না কেন, এটি আসলে কালো বা অবৈধ অর্থ।
সাধারণভাবে কালো টাকা বলতে বুঝানো হয় যার উৎস অবৈধ বা আইনসম্মত নয়। ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি, চোরাকারবার, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা কিংবা কোনো অন্যায় অপরাধের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ হচ্ছে কালো টাকা। আয়কর আইন অনুসারে
বৈধ উৎস থেকে অর্জিত অর্থও ‘কালো’ হতে পারে যদি টাকার মালিক তার আয়কর বিবরণীতে তার উল্লেখ না করেন; ওই টাকা করযোগ্য হলেও যদি কর না দেন। অবশ্য আয়কর আইনে কালো টাকা বলতে কিছু নেই। আইনের কোথাও শব্দটির উল্লেখ নেই। সেখানে অপ্রদর্শিত অর্থের উল্লেখ রয়েছে।
কেউ কেউ কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত অর্থের মধ্যে একটা স্পষ্ট সীমারেখা টানার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, ‘অপ্রদর্শিত অর্থের উৎস বৈধ হতে পারে, অবৈধও হতে পারে। কিন্তু কালো টাকার উৎস নিশ্চিতভাবেই অবৈধ। তাই বৈধ অপ্রদর্শিত অর্থের সাথে কালো টাকাকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।’ তবে নৈতিক মানদ-ে অসৎ উদ্দেশ্যে অপ্রদর্শিত বৈধ অর্থও অবৈধ হতে বাধ্য। কারণ, কর ফাঁকি দেয়াকে আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর যে কাজ শাস্তিযোগ্য, তা কোনোভাবেই বৈধ মনে করা যায় না। তাই কালো টাকার উৎস যা-ই হোক তা কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না।
কালো টাকা বিভিন্ন কারণে সমাজ ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এ অর্থ অপ্রদর্শিত থেকে যায় বলে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ ও অপরাধে ব্যবহারের অনেক বেশি আশঙ্কা থাকে। কালো টাকা আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শিত করা হয় না বলে রাষ্ট্র তা থেকে কোনো কর পায় না। অন্যদিকে, এ ধরনের অর্থ দুর্নীতিকে শুধু উৎসাহিত করে না বরং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিও দেয়।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে কালো টাকা ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। এই হার বেড়ে ২০০৭ সালে দাঁড়িয়েছিল ৩৭ শতাংশ এবং সাম্প্রতিক সময়ে এর পরিসর আরো বৃদ্ধি পেয়ে তা ৪০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। মূলত, কালো টাকা সম্পর্কে রাষ্ট্রের আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা এর পরিসর বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করা যায়। জানা গেছে, বিশ্বের ১৫১টি দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বা ছায়া অর্থ, অর্থাৎ কালো টাকার পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা জর্জিয়ায়-সাড়ে ৭২ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম সুইজারল্যান্ডে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সার্বিকভাবে সারা বিশ্বে কালো টাকার হার গড়ে ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। গোটা বিশ্বে কী পরিমাণ কালো টাকা আছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। অস্ট্রিয়ায় জোহানস কেপলার ইউনিভার্সিটি অব লিনজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডার ২২ বছর ধরে কালো টাকা নিয়ে কাজ করছেন। তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে কালো টাকার এ হিসাব পাওয়া যায়।
সব দেশকে নিয়ে এ সংক্রান্ত কাজটি শুরু হয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সহায়তায়। এই সমীক্ষা প্রতিবেদনটি ছিল অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা। এটি করা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকেরই ‘ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করার ব্যয়’ নামের প্রকল্পের অংশ হিসেবে। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) একটি দেশের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির হার এতে তুলে ধরা হয়।
তবে অনানুষ্ঠানিক বা কালো টাকার হিসাব প্রতিনিয়ত বদল হচ্ছে। এ কারণেই অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডার বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কালো টাকাসংক্রান্ত সমীক্ষাকে হালনাগাদ করছেন। প্রতিবেদনটির নাম দেয়া হয়েছে ‘শ্যাডো ইকোনমিজ অল ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড : নিউ এস্টিমেটস ফর ১৬২ কান্ট্রিজ ফ্রম ১৯৯৯-২০০৭।’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছায়া বা কালো অর্থনীতি সৃষ্টি হচ্ছে মূলত সরকারি কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কর-কাঠামোর অব্যবস্থার কারণে।
মূলত, কালো টাকার পরিমাণ বের করার কাজটি শুরু হয়েছিল ১১২টি দেশ নিয়ে। তথ্য দেয়া হয়েছিল ১৬২টি দেশের। তবে ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সব ধরনের তথ্য সমন্বয় করে ১৫১টি দেশের ছায়া অর্থনীতির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, গড়ে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা আছে লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে, ৪২ দশমিক ১ শতাংশ। সাব-সাহারান আফ্রিকায় এ হার ৪১ দশমিক ৩ এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় সাড়ে ৪০ শতাংশ। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা আছে দক্ষিণ এশিয়ায় ৩৪ শতাংশ এবং পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিকে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এই হার সাড়ে ২৮ শতাংশ। তবে ধনী দেশগুলোতে কালো টাকার হার তুলনামূলকভাবে কম। ৩২টি ধনী দেশের সমন্বয়ে তৈরি করা ওইসিডির কালো টাকা ১৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং এর বাইরের উচ্চ আয়ের দেশের কালো টাকা ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
দেশ হিসাবে সবচেয়ে বেশি অনানুষ্ঠানিক অর্থের মালিক জর্জিয়া। এর পরের অবস্থান বলিভিয়ার, ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ। শীর্ষ ১০-এর বাকি দেশগুলো যথাক্রমে আজারবাইজান (৬৯ দশমিক ৬ শতাংশ), পেরু (৬৬ দশমিক ৩), তানজানিয়া (৬৩), জিম্বাবুয়ে (৫৬ দশমিক ১), ইউক্রেন (৫৭ দশমিক ৫), গুয়াতেমালা (৫৩ দশমিক ৯ শতাংশ) প্রভৃতি।
সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা সুইজারল্যান্ডের পরই আছে যুক্তরাষ্ট্র, দেশটির ছায়া অর্থনীতির হার ৯ শতাংশ। এর পরের আটটি দেশ হলো যথাক্রমেÑঅস্ট্রিয়া (১০ দশমিক ১ শতাংশ), লুক্সেমবার্গ (১০ দশমিক ২), জাপান (১২ দশমিক ১), যুক্তরাজ্য (১৩ দশমিক ২), নেদারল্যান্ডস (১৩ দশমিক ২), নিউজিল্যান্ড (১৩ দশমিক ৬), সিঙ্গাপুর (১৪) ও চীন (১৪ দশমিক ৩ শতাংশ)।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের কালো টাকা ছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০০ সালে কালো টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০০১ সালে ৩৫ দশমিক ৭, ২০০২ সালে ৩৫ দশমিক ৫, ২০০৩ সালে ৩৫ দশমিক ৬, ২০০৪ সালে ৩৫ দশমিক ৭, ২০০৫ সালে ৩৬, ২০০৬ সালে ৩৬ দশমিক ৭ এবং ২০০৭ সালে আরো বেড়ে হয় ৩৭ শতাংশ। ক্রমবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপি ৪০ শতাংশেরও ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা।
মূলত, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে। মানুষ নানাভাবে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রতি ঝুঁকছে। মূলত, কর ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণেই এমনটি ঘটছে। আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে, ধনী দেশগুলোতে অনানুষ্ঠানিক অর্থের পরিমাণ কম, দরিদ্র দেশগুলোতে বেশি।
ফ্রেডরিক স্নেইডার ২২ বছর ধরে ছায়া বা অনানুষ্ঠানিক অর্থ নিয়ে কাজ করছেন। তা সত্ত্বেও তিনি মনে করেন, এখনো ছায়া অর্থনীতি, এর পরিমাণ, কারণ এবং এর প্রভাব সম্বন্ধে নির্ভুল তথ্য পাওয়া সহজ নয় এবং তাই এসব নিয়ে বিতর্ক আছে। এ জন্য প্রয়োজন আরো বেশি গবেষণা। আর তাহলে বিশ্বব্যাপী কালো টাকা নিয়ে আরো নির্ভুল তথ্য পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশেও কালো টাকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা থাকলেও এর পরিমাণ ও কারণ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। আশির দশকে ভারতে এ নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা হয়েছিল। আমাদের দেশে তা মোটেই হয়নি। ফলে এদেশে আসলে কালো টাকার পরিমাণ কত, তা জানার এখন পর্যন্ত একমাত্র উপায় অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডারের গবেষণা। কিন্তু দেশের মধ্যেই কালো টাকার পরিমাণ, উৎস এবং প্রভাব নিয়ে বড় আকারের সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
টিআইবি দাবি করেছে, দেশে কালো টাকার পরিমাণ মোট জিডিপির শতকরা ২৪.১ শতাংশ। কালো টাকা নিয়ে টিআইবির জরিপে দু’টি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। একটিতে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির ১০.১ এবং আরেকটিতে ৩৮.১ শতাংশ দেখান হয়েছে। দু’টির গড় করে জিডিপির ২৪.১ শতাংশ কালো টাকা নিরূপণ করা হয়। অর্থনীতিবিদেরা এ তথ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন- এই হার ৪০ শতাংশের বেশি।
মূলত, এসব কালো টাকার প্রধান উৎস দুর্নীতি। কালো টাকা যেমন আয় বৈষম্য বাড়ায়, তেমনি কালো টাকা প্রশ্নহীন থেকে গেলে দুর্নীতিও বাড়ে। আর ট্যাক্স ফাঁকিসহ নানা কারণে বৈধ আয়ও অনেক সময় কালো টাকায় পরিণত হয়। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশে নয় লাখ কোটি টাকার বেশি কালো টাকা আছে যা সরকারের দু’টি অর্থবছরের বাজেটের প্রায় সমান। এটা রীতিমতো উদ্বেগজনক নিঃসন্দেহে।
কালো টাকা নিয়ে যত কথাই বলা হোক বা তা বৈধ-অবৈধ যেকোনো খাত থেকেই আসুক না কেন, তা কোনোভাবেই বৈধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের পক্ষে কদর্য অর্থ ধবলীকরণের সুযোগ দানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অনিয়মকে উৎসাহিতই করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা। মূলত, দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি, সরকারের উদাসীনতা, শ্রেণিতোষণ, সময়োপযোগী আর্থিক নীতিমালার অভাব এবং সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতাও এর জন্য দায়ী। কিন্তু এই অশুভ বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছেন না সংশ্লিষ্টরা বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই সার্বিক পরিস্থিতির অবনতিই হচ্ছে। তাই কালো টাকার দৌরাত্ম্য অবিলম্বে বন্ধ করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। অন্যথায় দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম