মাছে ভাতের বাঙালী প্রবাদের আক্ষরিক কারণ হচ্ছে ঊর্বর জমি আর পানিভরা নদী। আর এ কারণে দিনাজপুর অঞ্চলকে কৃষিনির্ভর ও নদীমাতৃক জেলা বলা হয়ে থাকে। সেই বাঙালীপনার ঐতিহ্য এখন বিলীন হতে চলেছে। বর্তমানে জমি আছে, নদীও আছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষকরা জমিতে ফসল উৎপাদন করছে, কিন্তু পানিশূন্য নদীর কারণে মাছ ও সেচের আকাল দেখা দিয়েছে। উজানে ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের অধিকাংশ নদী শুষ্ক মওসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ায় নদীর বুকেই কৃষকরা আবাদ করে থাকে। চলতি বোরো মওসুমে দিনাজপুরে ৯৫ শতাংশ জমি সেচের পানি দিয়ে আবাদ করতে হচ্ছে। আর এতে ফসলের উৎপাদন খরচ যাচ্ছে বেড়ে। মৎস্যজীবিরা হয়ে পড়েছে বেকার। এককথায় নদীতে পানি না থাকায় পানি ও সেচনির্ভর সব কিছুতেই স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে।
দিনাজপুর জেলার ভিতর দিয়ে ছোট-বড় ১৯টি নদী বয়ে গেছে। সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুরের সবকটি নদীর উৎসমুখ ভারত। প্রতিটি নদীতে বালুর চর জমেছে। বালুচরের কারণে নদীতে কমেছে পানির পরিমাণ। নদীর সাথে সংযুক্ত খালগুলো পরিণত হয়েছে মরা খালে। পানি কমে যাওয়ায় কমেছে মাছ। মাছ কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মৎস্যজীবীরা। বৃহত্তর দিনাজপুরের করতোয়া, আত্রাই, কাঁকড়া, ঢেপা, পুনর্ভবা, গর্ভেশ্বরী, ছোট যমুনা, ইছামতি, ভুল্লী, পাথরঘাটা, নর্ত ছোট ঢেপা, বেলান, নলসীশা, তুলশীগঙ্গা, চিরি, তুলাই, মাইলা ও ভেলামতিসহ ১৯টি নদীর চিত্র একই। নদীগুলোতে পানি নেই বললেই চলে। খরস্রোতা নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে সরু নালায়। নদীর বড় অংশ জুড়েই পলি জমে ভরাট হয়েছে। অনেকেই সেই পলিতে চাষাবাদ করছেন। অনেক চরই ব্যবহৃত হচ্ছে খেলার মাঠ হিসেবে। শুধু বর্ষাকাল ছাড়া সবসময়ই এমন চিত্র দেখা যায়। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েকটি নদীর খনন কাজ শুরু হয়েছে। খননের পর এসব নদীতে কিছু পানি দেখা গেলেও খননকৃত এলাকায় সীমাবদ্ধ রয়েছে।
মহানন্দা, তিস্তা ধরলাসহ যেসব নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তার সবকটিতেই বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। ফলে খননের পরও এসব নদীতে পানির প্রবাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অপরদিকে নদীতে পানিপ্রবাহ না থাকায় ভূগর্ভেও পানির স্বল্পতা দেখা দিয়ে থাকে। নদীর গভীরতা কমে যাওয়াই এর মূল কারণ বলছে সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য নদীর খনন কাজ শুরু হওয়ায় এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
তবে ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে অনেক ছোট ছোট ও খাল হারিয়ে গেছে। গত ২০১৮ সালে বর্ষা মওসুমে পানির প্রবল স্রোতে দিনাজপুরের গাবুড়া নদীর দুটি শাখা নদীর মুখ খুলে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলাকাবাসী কেউ জানতোই না এটা কোন শাখা নদী। এখানে আবাদ হতো, ফলন হতো। এখন এটা শাখা নদী। যদিও শুষ্ক মওসুমে এখন এ শাখা নদীতে পানি না থাকায় গর্ত বা খাল ছাড়া আর কিছু বোঝার উপায় নেই। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে এসব নদী মরা খালে রূপ নিয়েছে। আবার বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি উপচে পড়ে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে নদীর সংখ্যা রয়েছে ১৯টি। সাম্প্রতিক সময়ে নদীর খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুনর্ভবা, আত্রাই, ঢেপা, গর্ভেশ্বরী, ছোট যমুনা, ইছামতি নদীরও খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আত্রাই ও পুনর্ভবা নদীর খনন কার্যক্রম করছে বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।
জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে জেলায় যেমন মাছের চাহিদা বেড়েছে, তেমনি মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে সেভাবে বাড়েনি মৎস্যজীবীর সংখ্যা। ২০১৬ সালে জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৫৭ জন। গত বছরে মাছের উৎপাদন হয়েছে ৫৬ হাজার ৯৬৫ মেট্রিক টন। যদিও জেলায় মাছের চাহিদা ৬২ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি।
দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার (দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়) ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯টি নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৭২৮ কিলোমিটার। নদীগুলোর উৎস্যস্থল হিমালয় পর্বত। কালের বিবর্তনে ও নদী সংস্কারের অভাবে পুনর্ভবা, করতোয়া, আত্রাই, ঢেপা, গর্ভেশ্বরী, তুলাই, কাঁকড়া, ইছামতি, ছোট যমুনা, তুলসী গঙ্গা, টাঙ্গন নদী এখন পরিণত হয়েছে ধু ধু বালুচরে।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার আজিমপুর ইউনিয়নের ভাবকি গ্রামের মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আগে বাড়িতে মেহমান এলে আমার বাবা-দাদারা নদীতে মাছ ধরে মেহমানদারি করতেন। গ্রামের অন্যরা মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতো, এখন মাছ তো দূরের কথা নদীতে পানিই নাই।
একই দাবি কাহারোল উপজেলার কান্তজী মন্দির সংলগ্ন গোবিন্দ দাসের। সদর উপজেলার দিঘন গ্রামের তোতা মিয়ার। তিনি বলেন, ‘ইরি আবাদের সময় বৃষ্টির পানি পাওয়া যায় না। পাতালের পানি নইলে নদীর পানি দিয়ে আবাদ করতে হয়।
নাম না প্রকাশের শর্তে দিনাজপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি বছরই খরা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। শুধু খরা মৌসুমেই নয়, বর্ষা মৌসুমেও পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ে ফসলের মাঠে। এখন শুধু বোরো মৌসুমেই নয়, বৃষ্টির অভাবে আমন মৌসুমেও শ্যালোর মাধ্যমে পানি সেচ দিতে হয় কৃষকদের।
দফতরটির তথ্যমতে, গত ১০ বছরে দিনাজপুর জেলায় স্থানভেদে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। পানির এই স্তর যতই নিম্নগামী হবে, ততই বাড়বে সেচ খরচ। এখন আগের তুলনায় পানি সেচের খরচ বেড়েছে স্থানভেদে ৬ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে কৃষি উৎপাদনে উভয় সঙ্কটে পড়েছেন উত্তরের জেলা দিনাজপুরের কৃষকরা।
সোর্স : ইনকিলাব