নানা অজুহাতে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। রমজান মাস শুরুর আগেই নিত্যপণ্যের বাজার হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত। পণ্য কেনার আগে পকেটে হাত দিয়ে বার বার চেক করছেন ক্রেতারা। চাহিদা অনুযায়ী বাজার করা যাবে কি-না। অনেকেই প্রয়োজনীয় পণ্য না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন। চাল, ডাল, ডিম, মাছ, মাংসসহ সবকিছুই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও আয় তেমন বাড়েনি। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষেরা বাজারে এসে করছেন হা-হুতাশ। শুক্রবার সরজমিন রাজধানীর তিনটি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে এ চিত্র।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পণ্যের দাম বাড়ানোর পেছনে আমাদের দায় নেই। আমাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
তাই বেশি দামে ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম যা বাড়ানোর আমদানিকারকরা বাড়াচ্ছে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখে গেছে, সপ্তাহ ব্যবধানে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই টাকা। শীত শেষ হওয়ায় মৌসুমি সবজিও বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। তেলাপিয়া-পাঙাশের মতো চাষের মাছের কেজিও হয়েছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। মাসখানেক ধরে অস্থির ব্রয়লার ও ডিমের দাম বেড়ে যাচ্ছে দফায় দফায়। বর্তমানে ২৪০ টাকা কেজির এসব মুরগির দাম সপ্তাহখানেক আগে ছিল ২২০ টাকা। আর এক মাস আগে বিক্রি হতো ১৬০ টাকা কেজি। একইভাবে ডিমের দাম মাসের ব্যবধানে হালিতে প্রায় ১৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা।
হাজারীবাগ বাজার: রমজানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হলো ছোলা-বুট। আর এ বাজারে সেই ছোলা-বুট এখনই কেজি ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক থেকে দেড় মাস আগেও ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। মাঝারি মানের লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে ব্রয়লার মুরগি কেজি ২১৫ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে পর্যাপ্ত শাকসবজি থাকলেও কিছু সবজির কেজি দেড়শ’ টাকা ছুঁইছুঁই। বেড়েছে আমদানিকৃত সব ধরনের ফলের দামও। দোকানে মিলছে না পর্যাপ্ত চিনি ও ছোলা। ডিম, মসলা ও মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যেরই দাম বেড়েছে।
রমজানের আগে মুরগির দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই বলে জানিয়েছেন হাজারীবাগ বাজারের বিক্রেতারা। তারা বলেন, বেশি দামে কিনতে হয়, এ কারণে আমাদের কিছু করার নেই। দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বিক্রি কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। বেশি দাম থাকলে তো মানুষ কিনতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা কেজি। আর খাসি ১১০০ টাকা কেজি। হাজারীবাগ বাজারের ১২৮ নম্বর মুদি দোকানের মালিক মো. মাসুম। তিনি জানান, রমজান শুরু হতে এখনো প্রায় এক মাস বাকি। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে আগুন। এখনই ছোলা-বুট বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজি দরে। যা এক থেকে দেড় মাস আগেও ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।
এই বাজারে নিয়মিত বাজার করতে আসেন হাজারীবাগ বাড্ডানগর এলাকার বাসিন্দা শেয়ার ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির। বাজারে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, এক বছরে বাজারে নিত্যপণ্যের প্রায় জিনিসের দামই দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু মানুষের আয়-রোজগার বাড়েনি। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে। তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে বাঁচবেন।
আরেক ক্রেতা খিজির আহমেদ। তিনি থাকেন ভাগলপুর এলাকায়। শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। একটি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। বলেন, বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব পণ্যের দামই লাফিয়ে বেড়ে যায়। কিন্তু মানুষের মূল্য বাড়ে না বছর ঘুরতে! স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে এই শহরে তার জীবন ভালো কাটছে না বলেও মন্তব্য করেন এই শিক্ষক। ফলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মাছ ও মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন খিজিরের পরিবার।
মধুবাগ বাজার: মৌসুম শেষ হওয়ায় বাজারে শীতের সবজির দাম ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি বেগুন ৮০ টাকা, করলা ১২০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, পটোল ১২০ টাকা, ঝিঙা ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারে প্রতি হালি লেবু ৬০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। এদিকে খুচরায় প্রতি কেজি কাঁচামরিচ ১৪০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতারা এক পোয়া বা আড়াই শ গ্রাম কাঁচামরিচ বিক্রি করেছেন ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। সেই হিসেবে কেজিতে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম পড়ছে কাঁচামরিচের।
অন্যদিকে প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৪০-২৮০ টাকা ও রসুন ১৬০-২২০ টাকা দরে। পাঙাশ- তেলাপিয়া ছাড়া অন্যান্য মাছের দামও কেজিপ্রতি ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দেখা গেছে। বর্তমানে মাছের বাজারে ইলিশ আকারভেদে ৩৫০ থেকে ৫০০, রুই ২৪০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মাঝারি দামের মাছের মধ্যে কেজিপ্রতি সিলভার কার্প ২০০ টাকা, পাঙাশ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, বাইলা ২৪০ টাকা, কাচকি ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের দাম ২০ টাকা বেড়ে ৭২০-৭৬০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
ব্রয়লার মুরগি (খুচরা) কেজিপ্রতি বিক্রি করছেন ২২০ থেকে ২৩০ টাকার মধ্যে। সোনালী মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকা, যা গতমাসেও ছিল ২৬০ টাকা কেজি। হাঁস প্রতি পিছ সাড়ে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব মতে, গত এক মাসে ব্রয়লার মুরগিতে দাম বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ।
খুচরা বিক্রেতা আতাউর রহমান বলেন, এই বাজারে একবার দাম বাড়লে সহজে কমে না। শীতের সবজি শেষের দিকে। ফলে দাম বাড়ছে। আরেক বিক্রেতা বলেন, যেসব সবজির মৌসুম শেষ সেসব সবজির দাম কিছুটা বেশি। কারণ ওইসব সবজির সরবরাহ কমে গেছে।
রিকশাচালক খালেক বলেন, জিনিসপাতির যা দাম, যেন দেশে নৈরাজ্য চলছে। দাম বেশি হওয়ায় কোনো কিছুই কিনতে পারছি না। খাবো কী, মোটা চালের দামও বেড়েছে। কোরবানির ঈদের পর গরুর গোস্ত কবে খেয়েছি মনে নাই। আত্মীয় আসলে কষ্ট করে মুরগি দিয়ে চালাতে হয়। তা ছাড়া এখন তো আর আগের মতো কামাই-রুজি নাই।
ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের কাঁচাবাজার: এ বাজারে ক্রেতারা এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ছুটছেন। সবকিছুর দাম শুনে কপালে ভাজ পড়ছে তাদের। পাশে থাকা বড় ‘মাছ বাজারটিও’ ক্রেতাশূন্য। ছুটির দিনেও নেই ক্রেতার ভিড়। বিক্রেতারা অপেক্ষা করছেন ক্রেতার। দু’একজন বাজারে এলেও দাম শুনে চলে যাচ্ছেন বা পরিমাণে কম কিনছেন। ক্রেতারা বলছেন, শাক-সবজি থেকে শুরু করে সবকিছু এখন আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। গরু-খাসির মাংস ছুঁয়ে না দেখতে পারলেও ডিম ও ব্রয়লার মুরগি দিয়ে ছোট-বড়দের চাহিদা পূরণ করতাম, এখন সেটির দামও নাগালের বাইরে চলে গেছে। সপ্তাহে ৩-৪ দিন ব্রয়লার মুরগি কিনতাম এখন সেটি এক মাসেও কিনতে পারছি না। কেউ কেউ তাজা মাছ, মাংস, ডিম কিনতে না পেরে শুঁটকির বাজারের দিকে ভিড়ছেন কিন্তু সেখানে গিয়েও দেখেন দাম বাড়তি। এই বাজারে দেখা গেছে, গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা, ছোট সাইজের চিড়িং মাছের কেজি ৬৫০-৭০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৪০-২৫০ টাকা, লেয়ার মুরগির কেজি ২৮০ টাকা, দেশি মুরগির ডিম হালি ৮০ টাকা, ব্রয়লার মুরগির ডিম ১৪৫-১৫০ টাকা ডজন, টমেটো ৪০ টাকা কেজি, মরিচের কেজি ১৬০, লাউ পিস ৬০ টাকা, লেবুর হালি ৩০, বরবটির কেজি ১২০, ঢেঁড়স ৮০ টাকা কেজি, করলা কেজি ১২০ টাকা।
ক্রেতা আজমল হোসেন বলেন, সপ্তাহের বাজারটা শুক্রবারই করা হয়। বাজারে এসে যে জিনিসের দাম শুনছি সেটিই বেশি ছাড়া কম না। প্রতিদিনই কিছু না কিছু দাম বাড়ছে। কোনো কিছু কিনতে সাহস পাচ্ছি না। দুই আঁটি শাক নিলাম ৩০ টাকা দিয়ে। মাংসের বাজারে গিয়ে দেখি ১৭০-১৮০ টাকার ব্রয়লার মুরগির দাম ২৪০-২৫০ টাকা চাচ্ছে। গত এক মাস ধরে মাছ, মাংস খেতেই পারছি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজনিন বলেন, আমি সব সময় ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের এই বাজার থেকেই কেনাকাটা করি। কিন্তু দিন দিন সবকিছুর দাম এত বেড়ে যাচ্ছে তাতে ঢাকায় থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের রান্না করে খেতে হয়। ডিমটাই বেশি ঘরে রাখার চেষ্টা করি সবসময় যাতে দ্রুত খেয়ে পড়তে বসতে পারি। সেই ডিম আজ দুই সপ্তাহ ধরে কেনাই বন্ধ করে দিয়েছি। ১০ টাকার মরিচ, হাফ কেজি টমেটো আর কাঁচা ৪টি কলা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি কেনার জন্য মূলত বাজারে আসা। কিন্তু এত দাম দিয়ে কেনা সম্ভব না। মাংস খাই না এক মাস ধরে।
ব্যবসায়ী রুবেল হোসেন বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়মিত ওঠানামা হচ্ছে। প্রতিদিন বাড়া ছাড়া কমছে না। একসময় ব্রয়লার মুরগি ১২০-১৫০ টাকা ছিল। সেই মুরগি এখন ২৩০-২৫০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। ডিমের ডজন পাওয়া যেতো ৯০-১০০ টাকার মধ্যে তা এখন বেড়ে ১৫০-২২৫ টাকা। আমাদেরও বেশি দামে ক্রয় করতে হচ্ছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, গরুর মাংস সবকিছুরই দাম বাড়তি। ক্রেতারাও কম কিনছে। আগে ৫ কেজি কিনলে এখন ১ কেজি কিনছে। এক-দুই বছর আগে যে দাম ছিল তা আর নামবে না।
অনুপম বিশ্বাস একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন সপ্তাহের বাজার করতে। অনুপম বলেন, মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতন পাই। দুই বছরে বেতন বাড়েনি এক টাকাও। অথচ বাজারে এসে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়। খরচ কমাতে আগামী মাস থেকে কম ভাড়ার বাসায় উঠবো। দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ দিতেও হিমশিম খেতে হয়। আমার না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু বাচ্চারা মাছ, মাংস, ডিম ছাড়া খেতে চায় না। তাদের কীভাবে বুঝাবো- আমি আর সামলাতে পারছি না।
সোর্স : মানবজমিন