মাঝবয়সি জালাল উদ্দিন, একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। থাকেন রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। গতকাল বাজার করতে এসেছিলেন খিলগাঁও রেলগেইট বাজারে। সবজি কেনা শেষে মুরগির বাজারে ঢুকতেই মুখটা অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেল। দেশি মুরগি, পাকিস্তানি মুরগির দাম জিজ্ঞেস করে কয়েকটা দোকান ঘুরে গেলেন ব্রয়লার মুরগির দোকানে। সেখানেও দামের আগুন। ব্রয়লার মুরগিও এখন বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা কেজি।
এ সময় কথা হয় জালাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, কীভাবে বাজার করব বলেন, দাম শুনলেই তো খাওয়ার শখ মিটে যায়। আমরা সীমিত আয়ের মানুষ। বাচ্চাদের একটি স্কুলে চাকরি করে যে মাইনে পাই তার অর্ধেকের বেশি বাসা ভাড়াতে চলে যায়। বাকি টাকায় পাঁচ সদস্যের সংসার কিছুতেই চলে না। ফার্মের (ব্রয়লার) মুরগির দাম আগে ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা কেজি ছিল। তখন ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় দেড়-দুই কেজি ওজনের একটা মুরগি কেনা যেত। এতে মাসে অন্তত দু’চারদিন বাচ্চাদের পাতে গোশত দেয়া যেত। এখন যেভাবে দাম বেড়েছে তাতে এই ফার্মের মুরগিও আর কেনা যাচ্ছে না।
জালাল উদ্দিন বলেন, কি বলবো বলেন, নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে সব মানুষের ত্রাহি অবস্থা। মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ ব্যয় হু হু করে বাড়ছে। এতে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আমাদের তো আয়ও অনেক কমে গেছে। স্কুলে আগে প্রতিটি ক্লাসে ৭০ থেকে ৮০ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিল। তখন প্রতি মাসে বেতন ছিল সর্বনিম্ন ক্লাসে ৮০০ টাকা মাসে। এখন বেতন ১০০ টাকা করে কমানো হয়েছে তাও অনেক ছাত্র-ছাত্রী কমে গেছে। প্রতি ক্লাসে এখন ৫০ জন করেও ছাত্র-ছাত্রী হচ্ছে না। এ ছাড়া আগে স্কুলের পাশাপাশি টিউশনি করেও মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হতো। এখন আর সেটাও হয় না। অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের স্কুলেই পড়াতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে টিউটর দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
শুধু জালাল উদ্দিনই নয় রাজমিস্ত্রির আবুল হাসেমেরও একই অবস্থা। রাজধানীর পূর্বরামপুরায় এক টিনসেড বাসায় ভাড়া থাকেন। ছয় সদস্যের পরিবার। একার আয়ে সংসার চলাতে হিমশিম অবস্থা। বাজার করতে এসে জিনিসপত্রের দাম দেখে তিনিও চিন্তায় পড়ে যান। কি কিনবেনÑ কি না কিনবেন, কিছুই যেন হিসাব মিলাতে পারছেন না। তার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, জিনিসপত্রের যে দাম, যে টেহা কামাই করি তা দিয়া কিছুই হয় না। বাজারে ১০০ টেহার ছোট মাছ কিনলে, বাকি টেহায় চাল, সবজি এসব আর কিনা যায় না। গত এক বছরেও গরুর গোশত কিনতে পারি নাই। গরুর গোশত খাওয়া এখন আর আমাদের কপালে নাই। আবুল হাসেম বলেন, যেইভাবে দিন যাইতাছে, সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেহি না। পরিবার চালাইতে হিমশিম খাইতাছি। একদিন কাম না পাইলে, ঘরে বইয়া থাকলে, পরের দিন খাওন জুটে না। যত কষ্ট শুধু আমরার মতো গরিব মানুষের।
রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগর, খিলগাঁও, টিএন্ডটি কলোনি বাজারসহ গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে ক্রেতাদের সাথে কথা বলে এমন চিত্র দেখা গেছে। নিত্যপণ্যের বাজার ক্রমশই লাগামহীন হয়ে পড়েছে। সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়ছে না কেবল মানুষের আয়। এ অবস্থায় শহুরে জীবনে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। চাকরি হারিয়ে, আয় না থাকায় অনেকেই শহর ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। শহরের মধ্য আয়ের কর্মজীবী মানুষ এখন আর ভালো নেই। সবাই এখন সবচে দুঃসময় অতিক্রম করছেন। মানুষের এই দুঃসময়ে শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, জীবন-যাপনে প্রয়োজনীয় যাবতীয় সবকিছুর দামই হু হু করে বাড়ছে। এতে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের। মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করা ব্যক্তিরাও এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, অফিসে যাতায়াতসহ সংসারের অন্যান্য খরচের সঙ্গে যোগ হয়েছে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক বাড়তি মূল্য।
রমজান মাস সমাগত। অথচ বাজার অস্থির হয়ে আছে। যেটা মোটেও কাম্য নয়। বাংলাদেশে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা আর কমতে চায় না, এটা স্বাভাবিক নিয়মে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে সব জিনিসের দাম হুট করেই বেড়ে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তখন বাজারে দাম কমানো হয় না। তখন বলা হয় এটা আগের দামে কেনা। এবার রমজান এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে যদি পণ্য মূল্য আবারও বাড়ে তবে মানুষ আরও অসহায় হয়ে পড়বে। অনেকের হয়তো দিনে এক বেলা খেয়ে দিনাতিপাত করতে হবে। দেশের একটি অনিয়ম এখন নিয়ম হয়ে গেছে। রমজানের সময় অনেক পন্যের মূল্য বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে খেজুর ও ছোলার দাম বেড়ে গেছে। ছোলার দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে গেছে। যে ছোলা গত মাসে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে তা এখন ৯০ থেকে ৯৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। খেজুর হয়তো রোজায় হাজার টাকা কেজি হবে। রমজান আসলে এসব পণ্যের দাম কেন বাড়ে, কারা বাড়ায় এটা দেখভাল করার কেউ আছে বলে মনে হয় না।
বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মন্সী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দেশে পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ আছে। রমজানে পণ্যের মূল্য বাড়বে না। কিন্তু তার কথায় ক্রেতারা এখন আর আস্থা রাখতে পারেন না। কেননা, তিনি বাজারে ভোজ্য তেলের দামই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী অসহায়ের মত শেষে শুধু বলেছেন, ব্যবসায়ীরা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। এবারও হয়তো তাই হবে। এবারও হয়ত বাড়বে। তারপর কী হবে তা জানে না কেউ। সরকার বিভিন্ন বিষয়ে নজর দেয়ার কথা বললেও সিন্ডিকেটকে কোনোমতে ভাঙতে পারছে না।
চলতি সপ্তাহে বাজারে দাম বেড়েছে কাঁচামরিচ, গরুর গোশত ও ব্রয়লার মুরগির। দেশি মুরগি এবং পাকিস্তানি কক মুরগি আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। মধ্যবিত্তের আমিষের চাহিদা মেটানোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান খামারে উৎপাদিত মুরগি ও ডিমের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। ডিমের হালি এখন ৫০ টাকায় পৌঁছেছে। মাছ গোশত না হলেও আগে অনেকে সন্তানের পাতে একটি ডিম সিদ্ধ বা মামলেট করে দিতে পারতেন। এখন সেটাও পারছেন না।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাজারে সবজির দামও গত সপ্তাহের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। আকারভেদে বাঁধাকপি ও ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায়। শসা প্রতি কেজি ৪০-৫০, লম্বা ও গোল বেগুন ৬০-৮০, টমেটো ৩০-৪০, শিম ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। করলা ১১০-১২০, ঢ্যাঁড়স ১০০, চাল কুমড়া প্রতিটি ৫০-৬০, লাউ প্রতিটি আকারভেদে ৭০-৮০, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০-৫০, চিচিঙ্গা ৬০, পটল ৬০, কচুরলতি ৬০-৭০, পেঁপে ৩০-৪০, বরবটি ১০০-১২০ ও ধুন্দুল ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচাকলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকায়। লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ টাকা। বেড়েছে কাঁচামরিচের দাম। প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগে কাঁচামরিচের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।
শান্তিনগর বাজারের কাঁচামরিচ বিক্রেতা আরমান বলেন, কাঁচামরিচের দাম গত সপ্তাহে ৭০ থেকে ৮০ টাকা ছিল এ সপ্তাহে তা বেড়ে দিগুন হয়েছে। কাঁচামরিচের আমদানি বন্ধ থাকায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।
তবে বাজারে আলু এবং পেঁয়াজের দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে। আলু ২০ টাকা এবং পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি করা বড় রসুনের কেজি ২০০ টাকা। দেশি ছোট রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়। বাজারে আদার দামও বেশ চড়া, প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। বাজারে খোলা চিনি প্রতি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। খোলা আটার কেজি ৬০ টাকা। প্যাকেট আটার কেজি ৬৫ টাকা। আগে কেজি ছিল ৭০ টাকা। ২ কেজির প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। দেশি মসুরের ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। ইন্ডিয়ান মসুরের ডালের কেজি ১২০-১২৫ টাকা। সয়াবিন তেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৮৭ টাকায়। লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকা কেজি। ফার্মের মুরগির ডিম বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। হাঁসের ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। দেশি মুরগির ডিমের ডজন ১৯০ টাকা। গরুর গোশতের দাম বেড়েছে। কেজি ৭৮০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হতো ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়।
শাহজাহানপুরে খলিল গোশতের দোকানের বিক্রেতা বলেন, গরুর গোশতের দাম বেড়েছে। আমরা আগে যে দামে গরু কিনতাম এখন তা থেকে অনেক বেশি দামে গরু কিনতে হচ্ছে। খামার ও গেরস্তের গরুর মালিকরা বলছেন, গো খাদ্য থেকে শুরু করে সব কিছুর দাম বাড়তি। এ কারণে গরুর দাম বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এ বিক্রেতা বলেন, গরুর গোশতের দাম আরো বাড়বে। শবে বরাতের আগেই কেজি ৮০০ টাকা হবে। খাসির গোশতের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা কেজি। আগে বিক্রি হতো ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা। গত মাসে ছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। সোনালি মুরগির দাম কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২০-৩৩০ টাকা। লেয়ার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকায়।
পাঙাশ-তেলাপিয়া ছাড়া অন্যান্য মাছের দামও কেজিপ্রতি ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দেখা গেছে। মাছের বাজারে কেজিপ্রতি শোল ৫০০ টাকা, বাইম ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজি, টেংরা ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, বোয়াল আকারভেদে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, শিং মাছ আকারভেদে ২৫০ থেকে ৩৫০, মাঝারি চিংড়ি ৬৫০, ছোট চিংড়ি ৪৫০ থেকে ৫০০, পাবদা ৩০০ থেকে ৩৫০, ইলিশ আকারভেদে ৪৫০ থেকে ৬০০, টাকি ৩০০, পুঁটি ৩০০ থেকে ৩৫০, রুই ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মাঝারি দামের মাছের মধ্যে কেজিপ্রতি সিলভার কার্প ২০০ টাকা, পাঙাশ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, বাইলা ২৫০ টাকা, কাচকি ২৫০ থেকে ৩০০টাকা, সুরমা ২০০ টাকা, পোয়া দেশি ১৬০, লালা পোয়া ১২০ টাকা, টাটকিনি ১২০ টাকা, ফলি ২০০, তেলাপিয়া আকারভেদে ১৬০ টাকা ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চালের বাজারেও অস্থিরতা চলছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই টাকা। তবে নাজির শাইল, মিনিকেট, কাটরিভোগ এসব চালের দাম গত সপ্তাহে যে দামে বিক্রি হয়েছে এখনো সেই বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। খিলগাঁও রেলগেট বাজারে চাল বিক্রেতা রোকন উদ্দিন বলেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে শুধু মোটা চালের দাম দেড় থেকে দুই টাকা বেড়েছে। আগে যে পাইজাম চাল প্রতি কেজি ৫৪ টাকা বিক্রি হতো তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা দরে। বাজারে অনেকের কাছে গুটি স্বর্ণা চাল নেই। মোটা জাতের ওই চালের সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে।
সোর্স : ইনকিলাব