চট্টগ্রাম নগরীর আমিরবাগ আবাসিক এলাকার তিন নম্বর সড়ক হয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিল বাংলাদেশ মহিলা সমিতি (বাওয়া) স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জেবা ফারিহা। হঠাৎ নির্মাণাধীন বহুতল ভবনটি থেকে বিশাল স্টিলের পাত বিকট শব্দে পড়ে রাস্তায়। তবে কয়েক সেকেন্ড আগে সড়কের অন্য পাশে চলে আসায় ভাগ্যক্রমে অল্পের প্রাণে বেঁচে যায় ওই কিশোরী। ঘটনার আকস্মিকতা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে টের পায় কিভাবে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছে সে। সড়কের পাশে বায়ো প্রপার্টিজ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির প্রকল্পের কাজ করছিল কোন নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই। সম্প্রতি স্কুল ছাত্রীর বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার এ ভিডিও ভাইরাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তবে স্কুল ছাত্রী ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও বাঁচতে পারেননি ঠিকাদার রওনক চক্রবর্তী ও জসিম উদ্দিন। বুধবার বিকেলে সড়কের পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একটি পুরাতন ভবন ভাঙার কাজ তদারক করছিলেন। দুতলা ভবনটির একটি অংশ হঠাৎ ফুটপাতে ভেঙে পড়ে। তাতে চাপা পড়েন দুজন। জসিম ঘটনাস্থলে আর রওনক ঘণ্টা দুয়েক পর হাসপাতালে মারা যান। জামালখানের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোন রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই চলছিল ভবন ভাঙার কাজ।
কয়েকদিন আগে কল্পলোক আবাসিক এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে একসাথে তিন শ্রমিক মারা গেছেন। আবাসিক এলাকার ২ নম্বর সড়কে মাহবুব রহমানের নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জগন্নাথপুর এলাকার মো. ইস্রাফিল, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর মো. রিপন এবং রাজশাহীর তানোরের সাকিম আলী। কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় আট তলা ভবন থেকে পড়ে নিমেষেই প্রাণ হারায় তারা। নগরীতে বেঘোরে এমন মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কোনো ধরনের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ছাড়াই অবাধে চলে বহুতল ভবন নির্মাণ ও ভাঙার কাজ। বিল্ডিং কোড মানছে না কেউ। ফলে এসব প্রকল্প মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। অথচ সংশ্লিষ্ট সংস্থা নির্বিকার, ফলে অবহেলায় একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু যেন এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ভবন কিংবা দেয়াল ধসে পথচারীসহ সাধারণ মানুষের প্রাণও যাচ্ছে। এক একটি মৃত্যু এক একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। অথচ মানুষের জীবন নিরাপদ করতে কোন উদ্যোগ নেই। সবার প্রশ্ন অবহেলায় আর কতো মানুষের জীবন গেলে প্রশাসনের ঘুম ভাঙবে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীতে উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি অনেক ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। কিন্তু এসব কাজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বা সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে প্রায় শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আবার নির্মাণ সামগ্রী পড়ে কিংবা দেয়াল ধসে পথচারী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। নগরীর জুবিলী রোড এলাকায় নির্মাণাধীন দেয়াল ধসে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে কয়েক বছর আগে। সেন্টপ্ল্যাসিড স্কুলের ধসে বাবা ছেলের মৃত্যুর ঘটনা ছিল আলোচিত। আগ্রাবাদ ডেবার পাড়ে জুমার নামাজের পর বাড়ি ফেরার পথে দেয়াল ধসে দুই মুসল্লির মৃত্যু এখনো ভুলতে পারেনি এলাকাবাসী। উন্নয়ন প্রকল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। আবার ঝুঁকি নিয়েই চলতে হয় পথচারীদের। সংস্কারের জন্য নালা উন্মুক্ত করে ফেলে রাখায় নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। এরপরও প্রশাসনের টনক নড়ছে না। উন্নয়ন প্রকল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। এসব দেখার দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশনের হলেও তারা নির্বিকার।
জামালখানের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সবার নাকের ডগায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে ভাঙা হচ্ছিল ভবন। অথচ কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। দেয়াল ধসে দুই জনের বেঘোরে মৃত্যুর পর সব সংস্থা তৎপর হয়েছে। এভাবে চোখের সামনে অনিয়ম চলছে, কোন ব্যবস্থা নেই। কোন দুর্ঘটনা বা প্রাণহানি ঘটলেই সবাই তৎপর হয়, কিছুদিন পর সব কিছু চলে আগের মতো। সংসারের হাল ধরতে এই নগরীতে এসে লাশ হয়ে ফিরছে অনেক নির্মাণ শ্রমিক। তাদের পরিবারে নেমে আসছে গভীর হতাশা, চরম অনিশ্চিয়তা। এসব দেখার দায়িত্ব যাদের তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নিয়ম না মানার অভিযোগ। সিডিএর পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে খাল নালা সংস্কার কাজে অবহেলায় নালায় পড়ে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও নেই। সিডিএর বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণ কালে গাডার ধসে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম কিছুদিন গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এরপর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। ওই ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। কিন্তু আদালতে সাক্ষ্য দিতে কেউ আসছে না। হতভাগ্য পরিবারের সদস্যদের বিচারের অপেক্ষা শুধুই বাড়ছে।
সোর্স : ইনকিলাব