বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। গত দুই মাসের ব্যবধানে শুধু নিত্যপণ্য নয়, দুই দফা বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। বেড়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপি গ্যাসের দামও। এতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস নির্ভর নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুই মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৮ থেকে ৮৭ শতাংশ।
গত ২২ ডিসেম্বর ও ২৩ ফেব্রুয়ারির বাজারদরের তুলনামূলক চিত্রে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ব্যবধানটি স্পষ্ট। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনে যা বেশ চাপ সৃষ্টি করছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার তদারকি জোরদার করার পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি এবং খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
মূল্যস্ফীতি মূলত কোনো পণ্য বা দ্রব্যের দাম বাড়ার গতির হিসাব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে ৪২২টি নিত্যপণ্যের ওপর ভিত্তি করে এই হিসাব করে থাকে।
বিবিএসের তথ্য মতে, বিদায়ি বছরের আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫২ শতাংশ, চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা ৮.৫৭ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে পণ্যের দাম বাড়ার গতি কমেছে ০.৯৫ শতাংশ। তবে বাজার পরিস্থিতি এবং গত জানুয়ারি মাসে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি কমবে না বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা, বরং তা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও জোয়ারসাহারা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। দুই মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৫৭ শতাংশ দাম বেড়ে এখন ২২০ থেকে ২৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সোনালি মুরগির দাম ২৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি এখন ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা। গত ২২ ডিসেম্বর ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন ছিল ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, দুই মাসে ২২ শতাংশ দাম বেড়ে এখন তা ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। আমদানি করা চীনা আদার দাম ৮৭ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায়। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দেশি আদার দাম। ৩০ শতাংশ দাম বেড়ে এখন তা ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
দুই মাসের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে রসুনের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। দুই মাস আগে আমদানি করা রসুন প্রতি কেজি বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। দুই মাসের ব্যবধানে দেশি রসুনের দাম ৭১ শতাংশ বেড়ে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা।
বাজারে চিনির সংকট এখনো কাটেনি। প্যাকেটজাত চিনি উধাও।
১০ শতাংশ দাম বেড়ে খোলা চিনি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। দেশি বলে পরিচিত চিকন মসুর ডাল কেজিতে ৮ শতাংশ দাম বেড়ে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবির বাজারদরের তথ্যে দেখা গেছে, আমদানি করা রসুনে গত এক বছরে ৬২ শতাংশ দাম বেড়েছে। টিসিবির বাজারদরে অবশ্য একসঙ্গে দুই মাসের তথ্য নেই। গত মাসে ১৪০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া আমদানি করা রসুন এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৯০ টাকায়। এক বছরে দেশি রসুনের দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশি রসুন প্রতি কেজি এখন ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, এক মাস আগে ছিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
গত এক বছরে আমদানি করা আদার দাম ১৪৭ শতাংশ বেড়েছে। এখন তা সর্বোচ্চ ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও তা ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। গত এক বছরে দেশি আদার দাম ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়, গত মাসে বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। টিসিবির তথ্যে জানানো হয়, গত এক বছরে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এখন হালি বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫০ টাকায়, গত মাসে যা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সুযোগ নেই। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে উৎপাদন খাতে এক ধরনের প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া শীতকালীন সবজির সরবরাহ কম হবে। নতুন ধান আসতে আরো তিন-চার মাস। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো কারণ দেখছি না। বরং তা বাড়তে পারে, যদি সরবরাহ চেইন ঠিক না থাকে।’
তিনি বলেন, ‘আসছে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের চাহিদা কিছুটা বেশি থাকবে। সুতরাং সরকারের উচিত, এই সময়ে সরবরাহ ঠিক রাখা। আমদানি ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা। আবার সরকার চাইলেও বেশি আমদানি করতে পারবে না। তার অন্যতম কারণ হলো ডলারের কিছুটা সংকট এখনো আছে। তবে এই সরকার চেষ্টা করছে, দেখা যাক সমানে কী হয়।’
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের মেসার্স মা আয়েশা ব্রয়লার হাউসের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজারে মুরগির সরবরাহ কমে যাওয়ায় কয়েক দিন আগে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৪০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। এখন দাম কিছুটা কমে আজ (গতকাল) ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ৩২০ টাকা এবং দেশি মুরগি প্রতি কেজি ৫৩০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ার কারণে অনেক খামারি খামারে বাচ্চা ফোটাচ্ছেন না। এতে বাজারে ব্রয়লার মুরগির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে দামও বেড়ে গেছে।
জোয়ারসাহারা বাজারের ভাই ভাই স্টোরের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম এবং সিয়াম স্টোরের ব্যবসায়ী মো. রমিজ উদ্দিন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাত্র কিছুদিন আগে ডিমের দাম বেড়ে ডজন ১৫০ টাকা হয়েছিল, এখন কিছুটা কমে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে দুই মাস আগে ডিমের ডজন বিক্রি করেছি মাত্র ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। আমদানি বাড়লেও কমছে না আমদানি করা আদা ও রসুনের দাম। আমদানি করা রসুন প্রতি কেজি ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি রসুন ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা আদা প্রতি কেজি ২৮০ টাকার নিচে নামছে না। তবে দেশি বলে পরিচিত কেরালা আদা প্রতি কেজি ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
জোয়ারসাহারা বাজারে গতকাল এক মুদি দোকান থেকে ২৫০ গ্রাম মসুর ডাল, ২৫০ গ্রাম রসুন ও আধাকেজি পেঁয়াজ কিনতে দেখা যায় এক ক্রেতাকে। তাঁর নাম মো. জুয়েল বলে জানান। তিনি পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। দৈনিক মজুরি পান ৫০০ টাকা। থাকেন নির্মীয়মাণ ভবনেই।
জুয়েল জানান, গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধা মা, দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রী থাকেন। বড় মেয়ে কলেজে পড়ছে, ছোট দুই ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে। তাদের পেছনে মাসে তিন-চার হাজার টাকা খরচ হয়। তিনি বলেন, ‘সব কিছুর দাম বাড়ায় সংসারের খরচ অনেক বাইড়া গেছে। খরচের সঙ্গে কুলাইয়া উঠতে পারতেছি না।’
এ ব্যাপারে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ভোক্তারা খুব কষ্টে আছে। সাধারণ মানুষের জীবনমানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে জোরালো চেষ্টা করতে হবে। বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিকাশ চন্দ্র সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ার কারণে পণ্য কেনার তালিকা কাটছাঁট করেও বাজার খরচ কমাতে পারছি না। দাম বেড়ে প্রতিটি পণ্যই আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।’
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, যেহেতু গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, বাজারে এর একটা প্রভাব আছে। নতুন করে এক মাসেই দুইবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
বাজার তদারকির বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের অভিযান চলমান। রমজান উপলক্ষে আগামী রবিবার আমদানিকারকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে বড় পরিসরে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছে। সভাটি টিসিবির অডিটরিয়ামে হবে।’
সোর্স : কালের কন্ঠ