দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় অর্থ হাতে না থাকলে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ধার নেয়। চাহিদার চেয়ে হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে ধারের সুদ কম হয়। চাহিদা বেশি হলে আর সেই অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর হাতে অপর্যাপ্ত নগদ অর্থ থাকলে ধারের সুদ বেশি হয়। ব্যাংকিং খাতে এ লেনদেন হয় ‘কলমানি মার্কেট’ নামক একটি উপকরণের মাধ্যমে। বেশির ভাগ ব্যাংকের হাতে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত নগদ অর্থ না থাকায় এ কলমানি মার্কেটে টাকার কদর বেড়েছে। আর এ কারণে এ মার্কেট থেকে সঙ্কটের মধ্যে থাকা ব্যাংকগুলোর ধার করতে এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ সুদ গুনতে হচ্ছে। অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের নির্বাচিত সূচক নিয়ে তৈরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি এ কলমানি মার্কেট থেকে ১০০ টাকা ধার নিতে যেখানে ব্যয় করতে হতো তিন টাকা ৯৮ পয়সা, গত ৩১ জানুয়ারি তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয় ছয় টাকা ৯৩ পয়সা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখীর কারণে কাক্সিক্ষত হারে মানুষ নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছেন না; বরং অভাবের তাড়নায় অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। এ কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। কিন্তু বিপরীতে বেড়েছে ঋণের প্রবৃদ্ধি। আগের বছরে যেখানে ছিল ঠিক বিপরীত অবস্থা। আমানতের চেয়ে যখন ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হয় তখন ব্যাংকের টাকার টান পড়ে। অনেক ব্যাংকের তখন দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় অর্থ হাতে থাকে না। বাধ্য হয়ে কলমানি মার্কেট থেকে ও ট্রেজারি বিল বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করে।
ব্যাংকগুলোর হালনাগাদ তথ্য নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৬৮ শতাংশ। বিপরীতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.১৯ শতাংশ। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম ছিল। কিন্তু গত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এসে ঋণ আমানতের চিত্র ঠিক বিপরীত অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে যেখানে ১২.৮৯ শতাংশ, আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঠিক তার অর্ধেকের কম অর্থাৎ ৫.৬৭ শতাংশ। ঋণ আমানতের প্রবৃদ্ধির এ বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে অনেক ব্যাংকেরই নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আর এ কারণে অনেক ব্যাংক দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে কলমানি মার্কেটসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি যেখানে কলমানি মার্কেট থেকে ধার করতে হয় ব্যাংকগুলোকে পাঁচ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা, আর চলতি ২৩ ফেব্রুয়ারি এসে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ধার করতে হয়েছে ছয় হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের গড় সুদহার অনেক কম। এ ছাড়া সবধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না; বরং অনেকেই অভাবের তাড়নায় সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এ কারণে ২০২১ ডিসেম্বর শেষে আমানতের সুদহার ছিল ৯.১৯ শতাংশ, সেখানে গত ডিসেম্বরে তা কমে নেমেছে ৫.৬৭ শতাংশ। আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের টান পড়েছে। এ অবস্থায় বেশির ভাগ ব্যাংকেরই নগদ অর্থপ্রবাহের ওপর চাপ রয়েছে। বিশেষ করে দুই সপ্তাহ পর পর যখন ব্যাংকগুলোর বাধ্যতামূলক নগদ জমা অর্থাৎ সিআরআর সংরক্ষণ করতে হয়, তখন ব্যাংকগুলোর টাকার টান পড়ে বেশি। এ কারণে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে বাড়তি ধার করে থাকে। আমানত বাড়ানোর নানা চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সেই সাথে বিনিয়োগের পরিমাণ একটি সামঞ্জস্যের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থানে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সোর্স : নয়া দিগন্ত