গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনামে ক্লান্ত ও নিরাশ এক পোশাক শ্রমিকের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে করা শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘চালের জন্য এমন যুদ্ধ আগে দেখি নাই’। আগেরদিন বুধবার চট্টগ্রাম নগরের সাগরিকার বিটাক মোড় এলাকায় আবদুর রহমান নামের ২৭ বছর বয়সী এই পোশাক শ্রমিকের পরনের গেঞ্জি ঘামে ভিজে একেবারে ‘জবজবে’ হয়ে গিয়েছিল। আরো কয়েকশ’ মানুষের সঙ্গে আবদুর রহমানও গিয়েছিলেন ওএমএস-এর মাধ্যমে তথা খোলা বাজারে সরকারের দেয়া পাঁচ কেজি চাল কেনার জন্য। ওএমএস-এর পণ্য নিয়ে ট্রাক আসারও তিন-চার ঘণ্টা আগে থেকে সেখানে শত শত মানুষ অপেক্ষা করছিল। অন্য সব দিনের মতো সেদিনও ট্রাক দেখেই মানুষের হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। সে কারণে বয়সে যুবক এবং প্ররিশ্রমী মানুষ হলেও পোশাক শ্রমিক আবদুর রহমানকে যথেষ্ট বেগ পেতে এবং কষ্ট করতে হয়েছিল। এজন্যই সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘চালের জন্য এমন যুদ্ধ দেখি নাই’। শুধু তা-ই নয়, প্রচন্ড ভিড়ের কারণে তার দমও নাকি বন্ধ হয়ে আসছিল। ওই চালের জন্য তাকে তিন ঘন্টারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এমন অবস্থা কিন্তু চট্টগ্রামেই প্রথম নয়। ওএমএস-এর পণ্য নিয়ে এই অবস্থা চলছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্য সকল অঞ্চলেও। বড় কথা, চলছে ওএমএসএ বিক্রির কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই। সরকারের পক্ষ থেকে আকর্ষণীয় প্রচারণা চালানো হলেও বাস্তবে খোলাবাজারে চাল এবং গম ও আটার মতো খাদ্য সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। একই কারণে সাধারণ মানুষকে ন্যায্য মূল্যের নামে ওএমএসএর চাল-গম কিনতে হচ্ছে। এবং কিনতে গিয়ে মারাত্মক দুর্নীতি ও দুর্গতির শিকার হচ্ছে তারা। বিক্রিতে অনিয়মসহ এসব বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে প্রাথমিক দিনগুলো থেকে। যতো দিন যাচ্ছে অভিযোগও ততো ব্যাপক এবং গুরুতর হয়ে উঠছে। এসব বিষয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংবাদপত্রে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবিধানের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে একদিকে অভাবী মানুষের কষ্ট বেড়ে চলেছে. অন্যদিকে বিক্রির দায়িত্বে নিয়োজিতজনদের বাড়াবাড়ি যাচ্ছে সীমা ছাড়িয়ে।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, সূর্য ওঠারও অনেক আগে থেকে পূর্বঘোষিত স্থানে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও অধিকাংশ মানুষ চাল ও আটা কিনতে পারছে না। কয়েকশ’ মানুষকে অপেক্ষমাণ রেখেই শেষ করা হচ্ছে বিক্রির কার্যক্রম। এ প্রসঙ্গে সব দৈনিকের রিপোর্টেই অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক বিভিন্ন তথ্য জানানো হচ্ছে। অন্যদিকে সত্য এড়িয়ে সরকার পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছ্,ে ওএমএস-এ বিক্রি করার জন্য প্রতিদিন দুইটন চাল এবং এক টন আটা দেয়া হয়। কিন্তু অভাবী মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, ওই পরিমাণ চাল ও আটায় তাদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এজন্যই চাহিদা ও সংকটের সঙ্গে দুর্নীতিও বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টজনেরা।
বিষয়টি আপত্তিকর সন্দেহ নেই, কিন্তু পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এমন অবস্থাই স্বাভাবিক। কারণ, রাজধানী ঢাকাকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা হলে দেখা যাবে, বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা যেখানে দেড় কোটিরও বেশি বলে মনে করা হয় সেখানে একটি বা দুটি ট্রাকে করে এক দুই টন চাল এবং এক টন আটা বিক্রির কার্যক্রম কোনোক্রমেই যথেষ্ট হতে পারে না। একই কারণে দুর্নীতি বন্ধ করার ব্যাপারেও আশাবাদী হওয়া যায় না। এজন্যই চাল ও আটার পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে প্রাথমিক দিনগুলো থেকে। আরো বলা হয়েছে, সরকারকে সেই সাথে দু’একটির পরিবর্তে কয়েকটি পর্যন্ত স্থানে বিক্রির কার্যক্রম চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আমরা আশা করতে চাই, সরকারের মধ্যকার দায়িত্বশীলরা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়ে উঠবেন। না হলে সেই দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে, যে ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই জনগণকে ভয় দেখানো হচ্ছে। আমরা মনে করি, জনগণকে ভয় দেখানোর পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের কথা স্মরণ করবেন এবং এমন সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নেবেন, যাতে জনগণকে আরো একবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে না হয়। যাতে হাজার হাজার মানুষকে আবারও অনাহারে মারা যেতে না হয়। উল্লেখ্য, সরকার স্বীকার করতে না চাইলেও অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন, বাস্তবে ইতিমধ্যেই দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে এবং সে কারণেই পোশাক শ্রমিক আবদুর রহমানরা না বলে পারছেন না যে, খাবারের জন্য এমন যুদ্ধ আগে দেখি নাই। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত বাস্তব অবস্থাকে স্বীকার করে নেয়া এবং জনগণকে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতেু এগিয়ে যাওয়া।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম