করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) ও ডেঙ্গুর ভয় নিয়ে বছর কেটেছে দেশের মানুষের। এর মধ্যে নতুন উদ্বেগ তৈরি করছে অ্যাডিনোভাইরাস। গত ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে এই ভাইরাসে। ২০১৮-১৯ সালের পর এবার অ্যাডিনোভাইরাসের সংক্রমণকে ‘ভয়াবহ’ বলছেন দেশটির চিকিৎসকরা।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সংক্রামক রোগ তো সীমানা মানে না। এটি দ্রুত একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। তাই নিজেদের সুস্থতার জন্য সবাইকে মাস্ক পরা বাড়াতে হবে। অ্যাডিনোভাইরাস বাংলাদেশে আগে থেকেই আছে। এর মধ্যে ভাইরাসটির ধরন পরিবর্তন হয়েছে কি না, সেটি দেখার বিষয়।
পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকদের বরাতে স্থানীয় আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, হাসপাতালে আসা শিশুদের শতকরা ৯০ জনেরই শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ (রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন) দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগই ভাইরাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগ আবার অ্যাডিনোভাইরাসের শিকার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা হলো রেসপিরেটরি ভাইরাস, যা শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। অনেকটা করোনাভাইরাসের মতো। মানুষের হাঁচি-কাশির মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে যায়। নাক বা মুখ দিয়ে ঢুকে সংক্রমণ ঘটায়। এ জন্য আমাদের মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার অভ্যাস আবারও বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ভাইরাসটি সাধারণত শিশু ও বয়স্কদের বেশি হয়। কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। অ্যাডিনোভাইরাস আমাদের দেশে আগে থেকেই আছে। এর মধ্যে ভাইরাসটির ধরন পরিবর্তন হয়েছে কি না, সেটি দেখার বিষয়।’
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পশ্চিম বাংলায় অ্যাডিনোভাইরাস হলে আমাদের অবশ্যই সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। যদি ভারত থেকে অ্যাডিনোভাইরাস সংক্রমিত কেউ দেশে আসে সে ক্ষেত্রে তার কোয়ারেন্টিন করা দরকার। এ ছাড়া অ্যাডিনোভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নাক-মুখ কাপড় বা রুমাল দিয়ে আটকে দেওয়া উচিত। শিশুদের সর্দি-কাশি-জ্বর হলে স্কুলে না দেওয়া। যেখানে বেশি মানুষ রয়েছে, এমন জায়গা এড়িয়ে চলা। নিজে আক্রান্ত হলে বাড়িতে অবস্থান করা—এগুলো মানতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সতর্কতা যেখানে নেওয়ার দরকার, নেওয়া হবে। এর আগে মাংকি পক্স নিয়ে যখন কোথাও কিছু হয়নি, তখনো কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সতর্কতামূলক অবস্থান নিয়েছিল। আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্তরা মৃদু থেকে গুরুতর অসুস্থ হতে পারে। তবে মারাত্মক অসুস্থতার প্রবণতা কম দেখা যায়। দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অথবা যাদের আগে থেকেই শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা ও হৃদরোগ রয়েছে, তাদের এই ভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।
এর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো—সাধারণ সর্দিজ্বর, গলা ব্যথা, তীব্র ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, চোখ ওঠা রোগ বা কনজাংকটিভাইটিস, বা অন্ত্রের প্রদাহ, যা ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব ও পেটে ব্যথা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া মূত্রাশয়ে প্রদাহ বা সংক্রমণ, নিউরোলজিক ডিজিস যেমন—ব্রেন ও স্পাইনাল কর্ডে সমস্যা হতে পারে।
অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা বা ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ নেই। আক্রান্তদের হাসপাতালে রেখে নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হতে পারে। অ্যাডিনোভাইরাসের টাইপ ৪ এবং টাইপ ৭-এর ভ্যাকসিন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তবে এ দুটি ধরনে আক্রান্ত বা উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশটির সামরিক কর্মকর্তাদেরই শুধু ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই নজরদারি করতে হবে। কারণ সংক্রামক রোগ তো সীমানা মানে না। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রামক খুবই দ্রুত ছড়ায়। আমাদের যে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসছে, তারা ভাইরাসে আক্রান্ত কি না, সেটি পরীক্ষা করা দরকার।’
যোগাযোগ করা হলে আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘আগে অ্যাডিনোভাইরাসের পরীক্ষা হতো। এখন আর সেটি হচ্ছে না। কারণ আপাতত আমাদের সার্ভেইল্যান্স ব্যবস্থা নেই।’
সোর্স : কালের কন্ঠ